মৃত্যুর হিমশীতল ছোঁয়াই এখন ওয়ানড়ে সবচেয়ে সত্যি, সবচেয়ে বাস্তব। কিন্তু সেই মৃত্যুমিছিল থেকেই জীবন ছেনে আনলেন উদ্ধারকারীরা। প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা থেকে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই জীবনে ফেরালেন চার শিশুকে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
একদিকে ধসের কারণে খাদ, আলগা মাটি পাথরের স্তূপ, মৃতদেহের টুকরো। অন্যদিকে লাগাতার বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। প্রকৃতির রুদ্ররোষে বিপর্যস্ত ঈশ্বরের নিজের রাজ্য কেরল। ভয়াবহ ভূমিধসে হারিয়ে গিয়েছে তিনশোর বেশি প্রাণ। মানচিত্র থেকে প্রায় মুছে গিয়েছে একাধিক জনপদ। কিন্তু একদিকে যখন এমন দুর্যোগ আর মৃত্যুর ঢল, তখনই অন্যদিকে হাতে হাত ধরে দুর্গতদের উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক মানুষ। কেবল মৃত্যুই যেন ওয়ানড়ের একমাত্র সত্যি না হয়ে ওঠে, এই ব্রতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন তাঁরা। আর তাঁদের মধ্যে জনাকয়েকই এবার জীবনে ফেরালেন চার উপজাতি শিশুকে। যারা তথাকথিত সভ্য নাগরিক সমাজের বাসিন্দা নয়। ফলে তাদের কথা কারও জানাও ছিল না, তাদের উদ্ধার পাওয়ার কোনও আশাও ছিল না। কিন্তু সেই অনিবার্য নিয়তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মৃত্যুকে হারিয়ে দিলেন কিছু মানুষই।
:আরও শুনুন:
বিপর্যস্ত ওয়ানড়ে সেতু গড়ে উদ্ধার দুর্গতদের, লিঙ্গবৈষম্য উড়িয়ে কুর্নিশ আদায় মেজর সীতার
ভূমিধসের পর থেকেই প্রাণের সন্ধানে ওয়ানড় চষে ফেলেছেন উদ্ধারকারীরা। নিখোঁজ মানুষদের খুঁজে পেতে ধ্বংসস্তূপে তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালাচ্ছেন তাঁরা। উদ্ধারের কাজে একযোগে হাত লাগিয়েছেন সেনা, বায়ুসেনা, নৌসেনা, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীরা। এর মধ্যেই কাজে নেমে পড়েন বনকর্মীরাও। জঙ্গল এলাকায় কোন পশু বা মানুষের বাস, সে খবর তাঁরা ছাড়া কেউই জানে না। আর তাঁদের এই তৎপরতাতেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে চার শিশু সহ মোট ছজনকে। বুক-পিঠের সঙ্গে কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা এক শিশুকে আগলে ধরে রেখেছেন এক বনকর্মী, নেটদুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে সে ছবি।
আসলে, ধসের পর আত্তামালার পাহাড়ি এলাকায় তল্লাশি অভিযানে বেরিয়েছিল চার বনকর্মীর দল। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন কালপেট্টা রেঞ্জের ফরেস্ট অফিসার কে হাশিশ। আত্তামালার পাহাড়ে গভীর জঙ্গলে পনিয়া উপজাতির কয়েকটি পরিবার থাকত, সে কথা জানা ছিল তাঁদের। লোকালয়ে খুব একটা যাতায়াত নেই এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। ফলে ধসের পর তারা কেমন আছে, আদৌ জীবিত আছে কি না, তার খোঁজ নিতেই গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়েন বনকর্মীরা। মুষলধারে বৃষ্টি, দুর্গম পাহাড়ি পথ আর নিচে গভীর খাদ, এ সবকিছুর মধ্যে দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই অভিযান চালিয়ে যান তাঁরা। সেই সময়েই এক মহিলা এবং তাঁর সঙ্গে বছর দুয়েকের একটি শিশুকে খুঁজে পান তাঁরা। যিনি ওই উপজাতি সম্প্রদায়ের। তিনি বুঝিয়ে দেন যে, মহিলার স্বামী এবং আরও তিন সন্তান পাহাড়ের একটি গুহায় আটকে রয়েছে। চড়াই বেয়ে সেই গুহার কাছে পৌঁছনো আদৌ সহজ ছিল না। যে কোনও মুহূর্তে পিছলে খাদে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল ষোল আনা। হার না মেনে ৮ ঘণ্টার মরণপণ লড়াইয়ে সকলকে উদ্ধার করেন বনকর্মীরা। বুঝিয়েসুঝিয়ে উপজাতি পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে আসতেও পারেন। আপাতত ত্রাণশিবিরে রাখা হয়েছে তাঁদের।
:আরও শুনুন:
বড্ড বেশি মানুষ গেল বানের জলে ভেসে! প্রকৃতির পূর্বাভাসকে গুরুত্ব দিতে শেখাবে ওয়ানড়?
বনকর্মীদের এই অমানুষিক কাজকে কুর্নিশ জানিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। তাঁর কথায়, এই বীরত্বই বুঝিয়ে দিল, অন্ধকার সময়েও কেরলের রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা জারি রয়েছে। আসলে, অন্ধকার যতই গাঢ় হোক না কেন, তার সঙ্গে নিয়ত যুঝেই চলে মানুষ। হার মানা তার অনিবার্য স্বভাব নয়। আর সেই আলোয় ফিরে আসার কাহিনিও আরও একবার লিখলেন ওয়ানড়ের এই উদ্ধারকারীরা।