ভোটের ময়দানে তাঁরা অভিজ্ঞ নন। সবে অভিষেক হচ্ছে মাত্র। আঙুলে কালি লাগবে প্রথমবার। অথচ তাঁরাই নাকি ঘুরিয়ে দিতে পারেন ভোটের খেলা। কী রহস্য মজুত তাঁদের ভোটদানে? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ভোটের ভিতর সবথেকে বড় যে কথাটি লুকিয়ে আছে, তা হল অনিশ্চয়তা। ভোটারের মনের হদিশ যদি সত্যিই পাওয়া যায়, তাহলে তো আর রাজনৈতিক দলগুলোকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় না। অথচ এই যে তীব্র গরমে ভোটের মাধুকরীতে রাজনীতিকদের পথে পথে ঘোরা, সে শুধু ওই মনের নাগাল পেতেই। নইলে এত প্রতিশ্রুতি, বিরোধীদের বিরুদ্ধে এত চোখা চোখা আক্রমণের কোনও মানেই থাকে না। বলতে গেলে, ভোটারের মন রহস্যময় এক ধাঁধা। যে দল যত সহজে তার সমাধান করতে পারে, শেষবেলায় বাজিমাত তারই। অর্থাৎ ভোটের মূল বিষয়টি হল, অনিশ্চয়তাকে নিশ্চয়তায় বদলে দেওয়া। আর সেখানে বড় ভূমিকা থাকে অনভিজ্ঞ নতুন ভোটারদেরও।
আরও শুনুন: রাজনীতির উপরে থাকুক আইন-সংবিধান, দেশ বাঁচাতেই মনে করাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি?
অবশ্য বলা যেতে পারে যে, চাওয়া-পাওয়ার হিসাবখাতায় এত গরমিল থেকে যায়, তার পরেও মানুষ ভোট দেয় কেন? বিশেষজ্ঞরা খতিয়ে দেখেছেন, ভোট দেওয়ার সঙ্গে অনেক অনুষঙ্গ জড়িয়ে থাকে। গণতন্ত্রে ভোটদানকে নাগরিক কর্তব্য হিসাবেই দেখা হয়। সেই মর্মে প্রচারও চলে। ফলে আগাগোড়া মানুষের মনে ভোটদানের কর্তব্য সম্পর্কে একটা ধারণা থেকেই যায়। যার টানে যত অসন্তোষই থাক, মানুষ ঠিক বুথের ওই আড়ালটুকুতে পৌঁছে যান। নিজের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার একটি উপায় হিসাবেও দেখা হয় ভোটদানকে। অর্থাৎ যিনি নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক, তিনি তাঁর দলের জয় তো চাইবেনই। আর সেক্ষেত্রে ভোট দেওয়াই হচ্ছে তাঁর একমাত্র পথ। কিংবা এর উলটোটাও কার্যকরী হয়। অর্থাৎ কোনও একটি বিশেষ ইস্যুতে একটি দল যেভাবে ঝাঁপাচ্ছে, তাতে একজন মানুষ হয়তো ভয় পাচ্ছেন। সে ভয়ের মাত্রা নানারকম হতে পারে। তখন তিনি চাইবেন, সেই দলকে পরাস্ত করতে, যাতে আশু এই আশঙ্কা থেকে তিনি মুক্তি পেতে পারেন। এক্ষেত্রেও তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা জানান দেওয়ার পথ হল ভোট। আর প্রাপ্তির আশা তো থাকেই। অর্থাৎ যে প্রতিশ্রুতির ঝুলি ভোটের মুখে রাজনৈতিক দলগুলি খুলে দেয়, তা পাওয়ার আশাতেই ভোট যায় আলাদা আলাদা দলের খাতায়। মোটের উপর এই হল ভোটারদের ব্যবহারের একটা গড় নকশা।
আরও শুনুন: প্রচারের আলোয় রামলালা, তবে মন্দির অর্থনীতিতে বাজিমাত কাশীর বিশ্বনাথেরই
এর মধ্যে আবার নানারকম তারতম্যও আছে। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর চাহিদা আলাদা হয়ে থাকে। সেই চাহিদা কোন দল কীভাবে পূরণ করছে তার উপর নির্ভর করে ভোটদান। রাজনীতির ভাষায় সাধারণত ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসাবে এই গোষ্ঠীর ভোটকে চিহ্নিত করা হয়। সেই নিরিখে বদলে বদলে যায় ভোটের অঙ্ক, প্রচারের কোণ, প্রতিশ্রুতির বন্যা। আবার লিঙ্গভেদেও এর ফারাক চোখে পড়ে। অর্থাৎ পুরুষ ও মহিলাদের প্রত্যাশা এক রকম নয়। মহিলাদের ভোট পেতে তাই সব দলই ঝাঁপায়। সেইমতো কর্মসূচি নেওয়া হয়; যদি দল সরকারে থাকে তো আগে থেকেই প্রকল্প ঘোষণা করে মহিলাদের কাছে টানারও প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
তবে, এই সবকিছুই প্রযোজ্য অভিজ্ঞ ভোটারদের জন্য। এর মানে এমন নয় যে, প্রথমবার যাঁরা ভোট দিচ্ছেন তাঁদের নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক বোধ নেই। তবে তাঁদের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার মাত্রাটা অনেক বেশি। অভিজ্ঞ ভোটারদের একটি নির্দিষ্ট ভাবনার অভিমুখে টেনে নিয়ে যাওয়া তুলমূলক সহজ; নতুন ভোটারের ক্ষেত্রে তা নয়, বিশেষত এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তো নয়ই। তবে, নতুন ভোটারদেরও কোনও একরৈখিক দৃষ্টিকোণ থকে দেখা যায় না। পারিবারিক রাজনীতির ঐতিহ্য থেকে তাঁদের ক্ষেত্রেও কারও কারও ভোট দেওয়ার দল বা ক্ষেত্র নির্দিষ্ট থাকে। তবে, সাধারণ ভাবে নতুন ভোটাররা যেভাবে তাঁদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, তাতে তাঁদের নিজস্ব যুক্তি-চিন্তা-ভাবনা কাজ করে। তা যে সবসময় ভোটের প্রচার বা বাড়ির মত দিয়ে প্রভাবিত করা যায়, তা নয়। তাঁরা তাঁদের নিজেদের বিচারবুদ্ধি দিয়েই বিবেচনা করে নেন কোন দিকে ভোট দেওয়া শ্রেয়; পাকা মাথার রাজনৈতিক যুক্তির সঙ্গে তা যে হুবহু মিলবে তা নয়; বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মেলে না। রাজনৈতিক তথ্যের জন্য তাঁরা প্রথাগত প্রচারমাধ্যমের উপর ততটাও নির্ভররশীল নন। এমন নয় যে, তাঁরা মাঠে-ময়দানে ভোটের প্রচার বা দেওয়াললিখন দেখছেন না; বা টেলিভিশনে ভোটযুদ্ধে নেতাদের ব্যবহার দেখছেন না; তা দেখার পরেও তাঁরা অনেকখানি বিশ্বাস রাখেন, পারস্পরিক কথোপকথন বা সংযোগের উপর। সেটা মূলত হতে থাকে সমবয়েসি বন্ধুবৃত্তের মধ্যে। সেই আলোচনা, প্রচার বা মিডিয়া থেকে পাওয়া রাজনৈতিক তথ্য, দলগুলির ব্যবহার সবকিছুর সংশ্লেষেই গড়ে ওঠে তাঁদের সিদ্ধান্ত। ফলত এই সিদ্ধান্ত যে খুব স্থির তা এক কথায় বলা যায় না।
আরও শুনুন: দুয়ারে ভোট, দেওয়া যাবে ঘরে বসেও, তবু কেন ধন্দে প্রবীণরা?
এখানে একটা বড় ভূমিকা নেয় সোশ্যাল মিডিয়া। ইদানীং রাজনৈতিক দলগুলি যে এই মাধ্যমকে প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার করেছে, তার একটা বড় কারণ এই নতুন ভোটারদের মন পাওয়া। এখন, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একটা নকশা আছে। সেখানে আলোচিত বিষয়, কোন আলোচনা কত বেশি রিঅ্যাাকশন পাচ্ছে ইত্যাদি প্যারামিটারও মতবাদ তৈরি করে দিতে পারে। এমনকী সমমনস্ক বৃত্তে কোন আলোচনা চলছে, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে চাহিদার রূপ কী, তা-ও একজন তরুণ ভোটারের রাজনৈতিক যুক্তি নির্মাণ করে। ভোটারদের ন্যূনতম চাহিদার বাইরেও তাই তাঁদের লক্ষ্য থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ভবিষ্যতের কর্মসূচি এবং জীবনের মানোন্নয়নের দিকে। অর্থাৎ অভিজ্ঞ ভোটার আর নতুন ভোটারের চাওয়ার মধ্যেও বিস্তর প্রভেদ থাকে। দলগুলির প্রতিশ্রুতি সেদিকে কতটা নজর রাখছে তার উপরও নির্ভর করে নতুন ভোটারের ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা।
সব মিলিয়ে নতুন ভোটারকে বুঝতে পারা সহজ নয়। আর সেই কারণেই তাঁদের ভোটে অনিশ্চয়তার ভাগ সবথেকে বেশি। অতীতে বহু নির্বাচনেই দেখা গিয়েছে, নতুন ভোটারদের ভোট ঘুরিয়ে দিতে পারে ভোটের খেলা। তুখোড় রাজনৈতিক দলগুলো তাই তাঁদের জন্য আলাদা করে ভাবনাচিন্তা করা শুরু করেছে। সাধারণ প্রচারের বাইরেও তরুণ ভোটারদের লক্ষ্য করেও তৈরি করে তাদের ইস্তাহার কিংবা প্রচার-যন্ত্র। নতুন ভোটাররা সংখ্যায় হয়তো অল্প, তবে অল্প ভোটেও যে হার-জয়ের হিসাব আমূল বদলে যেতে পারে তা কে না জানে! আর তাই নতুন ভোটাররা মোটেও মতবাদের বোড়ে নন; বরং রাজা-রানি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা আছে তাঁদের আঙুলের কালিতেই।