রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়। মাঝখানে পড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে আমজনতার। সে সব দিকে লক্ষ্য নেই যুদ্ধবাজদের। এদিকে মানবতাকে বাঁচাতে যে যার মতো করে চেষ্টা করে চলেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে। মানুষের মাথায় ছাদ তুলে দিতে কেউ খুলে দিচ্ছেন নিজেদের দরজা। কেউ বা সকাল থেকে দিনরাত পরিশ্রম করে দুমুঠো ভাতের জোগান দিয়ে যাচ্ছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষগুলোকে। বিনা পারিশ্রমিকে। এটা ব্যবসা বা লাভ-লোকসান দেখার সময় নয়। মানবতার খাতিরে ব্যবসা শিকেয় তুলে কোমর বেঁধেছে বড় বড় ফুড চেন। এক যুদ্ধের ভিতরে চলছে মানবতার অন্য লড়াই। শুনে নিন সেই গল্পই।
এখনও যুদ্ধ থামার লক্ষণমাত্র নেই। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধঘোষণার পর থেকে কেটে গিয়েছে প্রায় ২৩ দিন। ইতিমধ্যেই চার-চার বার আলোচনার টেবিলে বসেছে দুই দেশ। তবে সমাধান সূত্র বেরোয়নি। ন্যাটোর থেকে সাহায্য প্রত্যাশা করে করে হাল ছেড়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনেস্কি। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম এড়াতে ইউক্রেনকে অস্ত্রসাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি ন্যাটো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো। ইউক্রেনকে ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণার আবদনও কার্যত গ্রাহ্য করেনি তারা।
তবু এখনও প্রাণপনে লড়ে যাচ্ছে ইউক্রেন। ইতিমধ্যেই একাধিক শহরের দখল নিয়েছে রাশিয়া। রাজধানী কিয়েভ দখল করতে না পারলেও ক্রমশ আক্রমণের তেজ বাড়াচ্ছে রুশ বাহিনী। একের পর এক হামলা চলছেই। এরই মধ্যে একটি কিন্ডারগার্ডেন স্কুল এবং একটি মেটারনিটি হাসপাতালে লক্ষ্য করে বোমা ফেলার অভিযোগ ওঠে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে। মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য সদ্যোজাতের। ক্রমে পারমানবিক হামলার আশঙ্কা আরও দৃঢ় হচ্ছে। সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা ইউক্রেনবাসীর।
এর মধ্যে ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়েছেন অসংখ্য বাসিন্দা। তাঁরা ভিড় জমিয়েছেন প্রতিবেশী দেশগুলির সীমান্তে। হাজার হাজার শরণার্থী স্রোত এসে ঢুকছে সেসব দেশে। যাঁরা এখনও পালাতে পারেননি বা চাননি, বলাই বাহুল্য তাঁদের অবস্থা ভয়াবহ। খাবার নেই, জল নেই। শুধু বোমা পড়ার আতঙ্ক আর মৃত্যুভয়। মাথা বাঁচাতে বাঙ্কার বা সাবওয়ে স্টেশনে আশ্রয় নেওয়া শুধু। ইদানীং তো অসামরিক জায়গাগুলোকেও ছাড়ছে না রুশ সেনা। সম্প্রতি ইউক্রেনের একটি থিয়েটারে বোমা ফেলেছে তাঁরা, যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন কয়েকশো মানুষ। ফলে অবস্থাটা যে কতখানি সঙ্গীন, তা তো বোঝাই যাচ্ছে।
আরও শুনুন: যুদ্ধের বলি শৈশব, রাশিয়ার আক্রমণের জেরে নিহত ইউক্রেনের শতাধিক শিশু
হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল যুদ্ধটা। সামান্য আঁচ পেলেও এ ভাবে যে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক অভিযান শুরু করে দেবে রাশিয়া, তা বোধহয় ভাবতে পারেননি কেউই। গত ফেব্রুয়ারি থেকেই কিয়েভের এই রেস্তরাঁটি মাইনে দিতে পারেনি তাঁদের কর্মীদের। সব মিলিয়ে প্রায় জনা কুড়ি কর্মচারী। বেতন মিলছে না বলে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে অন্য কাজ খুঁজে নেবেন, সেই সুযোগটুকুও নেই যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে। কে না জানে, যুদ্ধ হলে খাবারের মজুতে টান পড়ে। তবু সকলে নিজের মতো করে চেষ্টা করে চলেছেন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার। আগে যেখানে একবেলার খাবার মিলত কম করে হলেও ১২ ডলারে, সেখানে প্রতিদিন ৫০০ প্লেট খাবার তৈরি করছে রেস্তরাঁটি। সেই খাবার তুলে দিচ্ছেন যুদ্ধবিধ্বস্তদের মুখে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।
আপাতত লাভ-লোকসান কিংবা ব্যবসা কোনও দিকেই তাকাচ্ছেন না ওই রেস্তঁরার মালিক অ্যানা কোঝাচেঙ্কো। মাস খানেক ধরে বেতন দিতে পারছেন না, তবু ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি কর্মচারীরা। বরং সকাল থেকে উঠে থেকে খাবার তৈরির কাজে লেগে পড়েন তাঁরা। কিয়েভ সংলগ্ন যে সব এলাকা আরও মারাত্মক ভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত, সেখানে পৌঁছে দিচ্ছেন খাবার। তাঁদের এই উদ্যোগে পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেকেই। দোকানটি যিনি ভাড়া দিয়েছিলেন অ্যানাকে, দোকানের ভাড়া আপাতত মকুব করে দিয়েছেন তিনিও।
আরও শুনুন: ইউক্রেনের যুদ্ধে যোগ দিয়ে শহিদ ১২ সন্তানের মা, গর্বিত পরিবার
না, শুধু অ্যানাই নন, ইউক্রেনে অভুক্তদের মুখে খাবার তুলে দিতে এগিয়ে এসেছেন সেখানকার অনেক ফুড চেনই। ইউক্রেনের প্রায় সাড়ে চারশোরও বেশি রেস্তরাঁ ব্যবসা ছেড়ে মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দিকে মন দিয়েছেন। ‘লা ফ্যামিগলিয়া’ নামে একটি গ্রুপের অন্তত ১৪টি রেস্তরাঁ রয়েছে ইউক্রেনে। ১৭ ফুড মার্কেট ছাড়াও রয়েছে তাদের ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারাও ব্যবসা ছেড়ে মন দিয়েছে মানুষের কাজে। যুদ্ধবিধ্বস্তদের মাথায় ছাদ আর মুখে খাবার তুলে দিতে প্রতি মুহূর্তে কাজ করে চলেছে তারাও। পৌঁছে দিচ্ছে ওষুধ। গত বছরও ব্যবসা থেকে কোটি কোটি টাকা লাভ করেছে যে সংস্থা, আপাতত আট হাজার জন মানুষের জন্য জলখাবার তৈরিতে ব্যস্ত তারা, প্রতিদিন অন্তত পাঁচ হাজার মানুষের হাঁড়ি চড়ছে তাদের পাকশালায়।
প্রত্যেকেরই দাবি, এটা একেবারেই ব্যবসা, লাভ কিংবা মার্জিন দেখার সময় নয়। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার সময় এখন। সেই মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখতে যে যার শেষ সম্বলটুকু বাজি ধরতেও তাই পিছপা হচ্ছেন না এতটুকু।