বন্যেরা বনে সুন্দর। অথচ তাঁদের সেই বনটাই যদি ক্রমশ হারিয়ে যেতে শুরু করে, তখন কোথায় যাবে এইসব প্রাণীরা! ‘পৃথিবীটা যে পাখি, গাছ, মানুষ সবার’ জানার পরেও কখনও কখনও মানুষের আগ্রাসন বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যের পক্ষে দুশ্চিন্তা তৈরি করে বৈকি। আর তখনই লাগে দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের ফলাফল স্বভাবতই এক বা একাধিক মৃত্যু। এদিকে, জঙ্গল আর লোকালয়ের এই দ্বন্দ্বের মাঝখানে মুনাফা লুটে বেরিয়ে যায় একদল স্বার্থান্বেষী। আর এ বার সেই বিষয়টি নিয়েই কড়া সিদ্ধান্ত নিল সুপ্রিম কোর্ট। জারি করেছে নির্দেশিকা। ঠিক কী জানিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বিদ্যা বালান অভিনীত সেই ‘শেরনি’ ছবিটির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। যেখানে একজন ফরেস্ট রেঞ্জারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিদ্যা। সেখানে দারুণ ভাবে প্রকাশ পেয়েছিল এই জঙ্গল আর লোকালয়ের দ্বন্দ্ব। কীভাবে একদল মুনাফালোভীর স্বার্থের শিকার হয়ে গিয়েছিল একটি বাঘিনী ও তার দুই শাবক। জঙ্গলের মধ্যে বাঘের যাতায়াতের পথ জুড়ে খোঁড়া হচ্ছিল খনি। ফলে মূল জঙ্গলে ফিরতে না পেরে বাধ্য হয়েই লোকালয়ে হানা দিতে শুরু করে বাঘিনীটি। সদ্য মা হওয়া বাঘিনীর পেটে যে তখন পাহাড়প্রমাণ খিদে। এর পর যা হওয়ার তা-ই হয়। ফরেস্ট রেঞ্জারের বহু চেষ্টাও সত্ত্বেও বাঁচানো যায়নি বাঘিনীটিকে। তবে গ্রামবাসীদের মিলিত চেষ্টায় বাঁচানো গিয়েছিল খুদে ব্যাঘ্র শাবকদুটিকে।
না। এ শুধু সিনেমার গল্প নয়। আদতে এ গল্প অবনী নামে একটি বাঘের। মহারাষ্ট্রের পেঞ্চ ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে আসা সেই বাঘটি দশ মাসের দুটি শাবক নিয়ে বাধ্য হয়েই ঢুকে পড়েছিল লোকালয়ে। বাঘটি লোকালয়ে মানুষ খুন করছিল এমন অভিযোগ এনে তাঁর ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়ে গিয়েছিল রাতারাতি। রীতিমতো পেশাদার শিকারি বহাল করে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল অবনীটিকে। ২০১৮ সালের সেই ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন অজস্র বনকর্মী। এমনকি তা পৌঁছয় সুপ্রিম কোর্টেও। যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশের শীর্ষ আদালতও।
আরও শুনুন: ‘জঙ্গল ছোড়ব নাহি’… হাতে তির-ধনুক, অরণ্য রক্ষায় একজোট প্রমীলাবাহিনী
স্বাভাবিক ভাবেই অবনীর নরখাদক হয়ে ওঠার পিছনে আসল কারণের দিকে নজর দিতে চায়নি কোনও পক্ষই। জঙ্গলের জমি যা আসলে বাঘের থাকার জায়গা তা বিক্রি করে ব্যবহার করা হচ্ছিল অন্য কাজে। আর সেজন্যই বাসস্থান ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয় অবনীরা। এমন ঘটনা কোনও নতুন ব্যাপার নয়। কখনও বেআইনি, তো কখনও আইনি পথেই চলে এভাবে জঙ্গল জবরদখল।
তবে এবার সে ব্যাপারেই বড়সড় সিদ্ধান্ত নিল সুপ্রিম কোর্ট। শুক্রবার একটি নির্দেশিকায় সুপ্রিম কোর্টের তরফে জানানো হয়েছে, ন্যাশনাল পার্ক বা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির বাফার জোনের এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনও রকম কারখানা বা খননের কাজ করা যাবে না। দেশের সবকটি জঙ্গল ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এলাকার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে এই নয়া নিয়ম।
আরও শুনুন: ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে সবুজের অভিযানে! আস্ত শহরকে গাছপালায় সাজিয়ে তুলেছেন লতিকা
যেসব জঙ্গল বা স্যাংচুয়ারির এক কিলোমিটারের মধ্যে ইতিমধ্যেই যেখানে এই ধরনের কাজ চলছে বা কারখানা গড়ে উঠেছে, সেসব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন চিফ কনসার্ভেটারের অব ফরেস্ট। জঙ্গলের চৌহদ্দির মধ্যে এই ধরনের কোনও নির্মাণ থেকে থাকলে তার তালিকা তিন মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে জমা করতে হবে। এই মর্মে ইতিমধ্যেই নির্দেশ পৌঁছে গিয়েছে প্রতিটি রাজ্যের প্রধান সংরক্ষক বা চিফ কনসার্ভেটারের কাছে। সম্প্রতি বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে একটি আবেদন জমা পড়েছিল শীর্ষ আদালতে। তারই শুনানিতে উঠে এসেছে এমন নির্দেশ। আশা করা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের পরে অবনীর মতো ঘটনায় কিছুটা হলেও রাশ টানা যাবে। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।