যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন ছেড়ে একা পালিয়ে এসেছিল এগারো বছরের ছেলেটি। প্রাণ বাঁচাতে কোলের ছেলেটিকে একাই অন্য একটা দেশে রওনা করিয়ে দিয়েছিলেন মা। ১২০০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পৌঁছেছিল সে স্লোভোকিয়া সীমান্তে। তারপর…? যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন জুড়ে যখন শুধুই ধ্বংস আর অনিশ্চয়তা, তখন কিছুটা হলেও আশা জোগায় সেই ছোট্ট হাসানের জিতে যাওয়ার গল্প। এর আগে একবার সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছে পরিবারটি। ফের যুদ্ধের দেশ থেকে পালাতে পালাতে অবশেষে মায়ের সঙ্গে দেখা হল ছেলের। গল্পে যা হয়, তা সত্যি হল বাস্তবেও। আর একা নয় ছোট্ট হাসান! আসুন, শুনে নিই ছোট্ট হাসানের সব ফিরে পাওয়ার গল্প।
দেখতে দেখতে ২৪ দিন কেটে গিয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন এখনও সেই অন্ধকারেই। যুদ্ধ থামার নামগন্ধ নেই। ফের রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে চলেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনেস্কি। এখনও পর্যন্ত অসংখ্য ইউক্রেনবাসীর মৃত্যু হয়েছে। দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন বহু। শান্ত সুজলা সুফলা ইউক্রেন এখন বধ্যভূমি কেবল। বাতাসে বারুদের গন্ধ। প্রতি মুহূর্তে শ্বাপদের মতো ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে মৃত্যু। প্রতিদিন একটু একটু করে আরও খারাপ হচ্ছে যেন পরিস্থিতি।
এতদিন ধরে প্রশাসন, সরকারের উপরে ভরসা রেখে এসেছেন স্থানীয়রা। ক্রমশ বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে ধৈর্যের। দু-দেশের মধ্যে ফলপ্রসু আলোচনা চান তাঁরাও। তবে আদৌ তা সম্ভব কিনা, সেই উত্তর জানা নেই কারওরই। ফলে আপাতত পালিয়ে প্রাণ বাঁচানো ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও উপায় নেই বাসিন্দাদের হাতে। তবে সবাই যে পালাতে পারছেন তা-ও তো নয়। অশক্ত যাঁরা, নাড়াচাড়া করতে পারেন না, তাঁরা দিন গুনছেন। হয় শান্তি ফিরবে, নয়তো প্রাণ কাড়বে রুশ বোমা। তবু যে যার মতো করে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। বাঙ্কারে গিয়ে মাথা বাঁচাচ্ছেন, কেউ লুকোচ্ছেন সাবওয়ে স্টেশনে। ক্রমশ আক্রমণের ঝাঁজ চড়াচ্ছে রুশ বাহিনী। হামলা চলছে অসামরিক এলাকাগুলিতে। মূলত স্কুল ও হাসপাতালগুলিকে নিশানা করে বোমা ফেলছে রাশিয়া।
আরও শুনুন: এখন ব্যবসার সময় নয়! যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে মানুষের মুখে বিনামূল্যে খাবার তুলে দিচ্ছে অসংখ্য রেস্তরাঁ
এত সব নৈরাশ্যের ভিড়ে আশার কথা কি কোথাও নেই ইউক্রেনে! কোথাও নেই জীবনে ফেরার গল্প? নিশ্চয়ই আছে। যুদ্ধ তো আসলে মানবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি শব্দ। আর তাঁর বন্দুক, গোলাগুলির ঠিক উল্টোদিকে থাকে মানুষের গল্প। তাঁদের জিতে যাওয়ার কথা।
যেমন জিতে গিয়েছে ১১ বছরের সেই ছোট্ট ছেলেটি। হাতের পাতায় লেখা একটা ফোন নম্বর খালি, আর মায়ের একটা চিঠি। সেটুকুকে সম্বল করেই যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়েছিল সে। বাড়িতে অশক্ত ঠাকুমা। তাঁকে ফেলে চলে আসতে পারেননি মা। এদিকে জাপরিজিয়ার পারমানবিক কেন্দ্রটি তখন জ্বলছে। ভয়ে দিশাহারা মানুষ। ছোট ছেলেকে সেই মৃত্যুর উপত্যকায় ফেলে রাখতে মন চায়নি মায়ের। পিঠে ছোট্ট ব্যাকপ্যাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আর জিনিস ভরে পাঠিয়ে দিয়েছিল স্লোভোকিয়ায়, একাই। সেখানে থাকেন এক আত্মীয়। তাঁর কাছে গিয়ে যদি ছেলেটার প্রাণটুকু বাঁচে।
আর সেই ছোট্ট ছেলেটি খুদে খুদে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় পৌঁছেছিল স্লোভোকিয়া সীমান্তে। প্রায় ১২০০ কিলোমিটার রাস্তা একাই হেঁটে এসেছে সে, অভিভাবকহীন। হাসান পিকাসা নামে সেই খুদে ছেলের গল্প দিনকয়েক ধরে ঘুরেছে খবরের পাতায়। স্লোভোকিয়া সীমান্তে তাঁর মুখে সামান্য খাবার, জল তুলে দিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। ইমিগ্রেশন অফিসার তাঁর আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করেছেন।
আরও শুনুন: যুদ্ধের বলি শৈশব, রাশিয়ার আক্রমণের জেরে নিহত ইউক্রেনের শতাধিক শিশু
এই অবধি গল্প তো সকলেরই জানা। স্লোভাক পুলিশের পাঠানো একটি ভিডিয়ো বার্তায় হাসানের মায়ের কাতরবার্তা ছড়িয়ে গিয়েছিল নেটদুনিয়ায়। কিন্তু তারপর! আদৌ কি ঘর খুঁজে পাওয়া হল হাসানের। আচ্ছা, মায়ের সঙ্গে দেখা হল কি তাঁর আর। নাকি যুদ্ধক্লান্ত ইউক্রেনে ছেলের দুশ্চিন্তায় পাথর হয়ে গেলেন মা। এতদিন ধরে এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেয়েছে অনেকেরই মাথায়। তার পর আরও যুদ্ধক্লান্তদের গল্পে চাপা পড়ে গিয়েছে সেসব প্রশ্ন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে যখন শুধুই মৃত্যু আর ধ্বংসের খবর! তবু জিতে যাওয়ার গল্পও তো থাকে কিছু, যা আশা জোগায় মানুষকে লড়াই করার। বেঁচে থাকার লড়াই।
জিতে গিয়েছে ১১ বছরের হাসান। স্লোভোকিয়ায় এসে সে খুঁজে পেয়েছে আত্মীয়ের বাড়ি। শুধু তাই নয়। অবশেষে ইউক্রেন ছেড়ে অন্যান্য ভাইবোনদের নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন তাঁর মা ও ঠাকুমা। সম্প্রতি মা ও বাকি ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা হয়েছে হাসানের। আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরেছে সে। একরত্তি ছেলের সঙ্গে যে আবার কোনও দিনও দেখা হবে তা ভাবতেও পারেননি মা জুলিয়া পিকাসা। ইউক্রেন ছেড়ে পালানোটা মোটেই সহজ ছিল না। কোনও মতে ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে চড়ে দেশ ছেড়েছিলেন তাঁরা। তবে শেষমেশ পরিবারকে ফিরে পেয়েছে ছোট্ট হাসান।
আরও শুনুন: ইউক্রেনের যুদ্ধে যোগ দিয়ে শহিদ ১২ সন্তানের মা, গর্বিত পরিবার
তবে যুদ্ধের মুখে এমন পালিয়ে বাঁচার ঘটনা তো আগেও বারবার ঘটেছে। এর আগে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে পালিয়ে এসেছিল হাসানের পরিবার। নতুন করে ঘর পেতেছিল ইউক্রেনে। এবার যুদ্ধের কবলে সেই ইউক্রেনও। ফের পালাতে বাধ্য হয়েছেন নিরুপায় জুলিয়ারা। অনেক কষ্ট করে সবটা সাজিয়ে নিয়েছিলেন। আবার হয়তো শূন্য থেকে শুরু করতে হবে, জানেন জুলিয়া। তবু প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন ঈশ্বরকে। কঠিন পথে যাঁরা ছোট্ট হাসানের সহায় হয়েছিলেন, তাঁদেরকেও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন জুলিয়া। আর মাকে কাছে পেয়ে বেজায় স্বস্তিতে ইউক্রেনের এই খুদে হিরো।