সমস্ত বিপদ-আপদ, যন্ত্রণা থেকে প্রিয়জনকে আগলে রাখতে চান প্রায় সকলেই। সেই প্রিয়জন-ই যখন মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে আর যন্ত্রণা লাঘব করতে তাঁদের এগিয়ে দিতে হয় জীবনের অন্তিম পরিণতির দিকে – তখন যে-যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় মানুষকে, তা বোধহয় ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। সম্প্রতি সেরকমই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন এক মহিলা, যা শুনে বাকরুদ্ধ হয়েছে গোটা বিশ্ব।
সাজানো-গোছানো সংসার ছিল ক্যারোলিনের। স্বামী, সন্তান নিয়ে যাকে বলে একেবারে সুখের সংসার। কিন্তু বিধি বাম! একদিন সেই সাজানো সংসার শুকিয়ে যায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়। একে একে হারাতে হয় স্বামী ও এক সন্তানকে। এমন শোকের মুহূর্ত হয়তো খুব কম মানুষের জীবনেই আসে। তবে ক্যারোলিনের জন্য অপেক্ষা করে ছিল আরও ভয়াবহ কিছু। শুধু প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলাই নয়, দুজনকেই মৃত্যুর পথে এগিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি নিজেই।
আরও শুনুন: অপমানের বদলা, রোলস রয়েস-কে জঞ্জালের গাড়ি বানিয়েছিলেন এই ভারতীয় রাজা
মর্মান্তিক, তবু স্মৃতির পাতা ওলটাতে ওলটাতে ক্যারোলিন ফিরে গিয়েছিলেন সেই ২০০৭ সালে। যে-বছর আচমকাই তাঁর ঝলমলে জীবনে নেমে এসেছিল শোক আর বিষাদের ছায়া। একখানা মিনি-মোটরবাইক নিয়ে খেলা করছিল ক্যারোলিনের ছোট্ট মেয়ে নাতাশা। আকস্মিক ঘটে গেল সেই ঘটনা। গ্যারেজের দেওয়ালে সজোরে ধাক্কা খেল ছোট্ট মেয়েটি। ছুটে এসেছিলেন ক্যারোলিনের স্বামী পল। মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোথায় লেগেছে? ছোট্ট মেয়ে মাথা নেড়ে বাবাকে অভয় দিয়ে বলেছিল, কিছুই হয়নি। সে এক্কেবারে ঠিক আছে। কিন্তু কোথায় কী! ছোট্ট মেয়ের মুখের কথা মুখেই থেকে গেল, পল আর ক্যারোলিনা নাতাশাকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালে। মারাত্মক চোট ছিল তার শরীরে, যা প্রথমে বোঝাই যায়নি। পরিস্থিতি ক্রমে এতটাই খারাপ হয় যে, ‘লাইফ সাপোর্ট’-এ রাখতে হয় নাতাশাকে। তবু, শেষরক্ষা হল না। একদিন চিকিৎসকদের ম্লানমুখ জানিয়ে দিয়েছিল নাতাশার জীবনে ফেরার আশা আর নেই। অর্থাৎ, যদি লাইফ-সাপোর্ট খুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তবে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে সে। কে নেবে সেই সিদ্ধান্ত? না, চিকিৎসকরা তা নিতে পারেন না। কঠোর সেই সিদ্ধান্ত নিতে হল ক্যারোলিনকেই। বুকে যেন পাথর রেখেই মেয়েকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন সেদিন। তখনও তিনি বোধহয় স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, যে, আরও কতখানি ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে তাঁর জীবনে।
আরও শুনুন: ভূমিকম্পে মৃত মালিক, ভাঙা বাড়ির সামনে ‘আত্মীয়ের’ খোঁজে তবু ফিরে আসে পোষ্য কুকুর
মেয়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করতে থাকেন ক্যারোলিনের স্বামী। তা-ও এইভাবেই গড়িয়ে গিয়েছিল বেশ কয়েকটা বছর। কিন্তু এই দায়ভার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি পল। একদিন আক্রান্ত হলেন হৃদরোগে। সেটা ২০১৬ সাল। একটা চেয়ারে বসে ছিলেন পল। আচমকাই চেয়ার সমেত পড়ে গেলেন মেঝেতে। আবার হাসপাতাল, আবার লাইফ সাপোর্ট… আর সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। প্রায় ১০ দিন লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় পলকে। কিন্তু এবারও হল না শেষরক্ষা। জীবনে আরও একবার ‘লাইফ সাপোর্ট’ যন্ত্রের সুইচ অফ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল ক্যারোলিনকে। মেয়ের মতোই বিদায় দিয়েছিলেন স্বামীকে। প্রিয়জনকে যন্ত্রণামুক্ত করার আর কোনও উপায়ই যে ছিল না তাঁর হাতে!
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এসে জীবনের এই মর্মান্তিক কাহিনি শুনিয়েছেন ইংল্যান্ডের বাসিন্দা ক্যারোলিন ব্ল্যানচার্ড। জীবন মাঝে-মধ্যেই নানারকম বিচিত্র অভিজ্ঞতার সামনে এনে দাঁড় করায় মানুষকে। তবু ক্যারোলিন যে-জীবনের গল্প শুনিয়েছেন তা বোধহয় বিরলতম। অসহ যন্ত্রণা মেনে নিয়েও, প্রিয়জনকে যন্ত্রণামুক্ত করতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেওয়া – ক-জনই বা পারেন এমন কাজ! ক্যারোলিন বাধ্য হয়েছেন তা করতেই – এক জীবনে দু’বার। তবু নিজের মতো করেই এখন বয়ে চলেছে ক্যারোলিনের জীবন। তাঁর গল্প তাই যেমন যন্ত্রণা আর শোকের, তেমন শোক পেরিয়ে জীবনে ফেরার গল্পও বটে।