সম্প্রতিই, খ্যাতনামা ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পল বলেছিলেন, আসল ইতিহাস আর হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। প্রকৃত ইতিহাসের কারবারিদের সঙ্গে আমজনতার যে বিস্তর দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে, সেই ফাঁক দিয়েই হুহু করে বেড়ে উঠেছে হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির নকল জ্ঞানের আগাছা। পবিত্র সরকার যেমন বলছেন, “যারা মতলববাজ, তারা এই গুজবগুলিকে একটা শক্তিশালী ও অব্যর্থ অস্ত্র হিসেবে তৈরি করে আর ব্যবহার করে।” কিন্তু সেই গুজবে ভর করেই কি এ সময়ে বেড়ে উঠছে না বিদ্বেষের বীজ?
দেশভাগের ইতিহাস ছিল। তার সঙ্গে লগ্ন হয়ে ছিল যন্ত্রণা আর সব হারানোর ইতিহাস। সে ইতিহাসের পাঠ নিয়ে ক্ষত সারানোর পথেই হাঁটা যেত। কিন্তু তার বদলে নতুন ক্ষত তৈরি করার দিকে ঠেলে দিল নয়া ইতিহাস। “নয়া ইতিহাস লিখছে ধর্মঘট,/ রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট”… এ কথা ভেবেছিলেন অনেকেই, যাঁরা রক্তাক্ত ক্ষতকে ভেবেছিলেন মুক্তিসংগ্রামের নিশান। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, শাহবাগের বাংলাদেশ নতুন আন্দোলনের পথে গড়ে উঠবে নতুন করে, এ আশা ছিল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে সেই আন্দোলন এসে পৌঁছল ঘৃণা আর বিদ্বেষের ভূমিতে। অনেক রক্তের দামে একদিন যে ভাগাভাগির বয়ান লেখা হয়েছিল, সেই ঘা-কেই ফের খুঁচিয়ে দেওয়া শুরু হল তাই। পালটা জবাব শানাতে শুরু করল এ দেশও। সব মিলিয়ে, সোশ্যাল মিডিয়া যে ঘৃণার ইতিহাস ছড়াচ্ছে, তার পাঠ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেই আপাতত লেখা হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ, বিশেষ করে এপার ও ওপার বাংলার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নষ্টের ইতিহাস।
এই যে ঘৃণার ইতিহাস ছড়িয়ে দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া, এই ইতিহাসকে আগুপিছু বিচার না করেই কিন্তু বিশ্বাস করছেন একটা বড় অংশের মানুষ। সম্প্রতি যেমন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা টেনে বলেছেন, পড়শি দেশের বাসিন্দাদের একাংশের মধ্যে “এক আশ্চর্য অন্ধতা ও বিশ্বাসপ্রবণতা রয়েছে। তাঁরা অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য সব গুজবে বিশ্বাস করেন। প্রশ্ন করেন না, যুক্তিসংগত কি না বিচার করেন না। জাহাঙ্গিরনগর থেকে ঢাকার পথে আমি এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে শুনেছিলাম যে, তাঁরা জানেন, শেখ মুজিব ভারতকে বাংলাদেশের অনেকটা জমি দিয়ে গেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়? তিনি বললেন, কেন, খুলনায়!” বোঝাই যাচ্ছে, যে বিদ্বেষ বা অবিশ্বাসের বীজ অন্তরে ছিল, তা কোনও গুজব পেয়েই তাকে আঁকড়ে ধরেছে, বিচার বিবেচনা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। এ জাতীয় গুজব ডানার জোর পেয়ে গিয়েছে ডিজিটাল যুগে। ইন্টারনেটে ভর করে মুহূর্তে যে কোনও কথা যে কারও কাছে পৌঁছে দেওয়া যেহেতু সম্ভব, সম্ভব একসঙ্গে চেনা-অচেনা অনেক লোককে কোনও মেসেজ ফরোয়ার্ড করে দেওয়া, ফলে যে কোনও গুজব বা ভুল খবর এই সময়ে দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন ২০২১-এর দুর্গাপুজোর সময় কুমিল্লা ও সংলগ্ন এলাকায় পূজামণ্ডপ, মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের যে ঘটনা ঘটে, সেই মর্মান্তিক সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের জন্য দায়ী ছিল পবিত্র কোরান অবমাননার একটি উস্কানিমূলক ও ভ্রান্ত ফেসবুক লাইভ।
এই ডিজিটাল মিথ্যার অন্ধত্ব কি এ দেশেও নেই? ভারতকে অপমান করতে বুয়েট-এর সামনে মাটিতে আঁকা হয়েছে ভারতের জাতীয় পতাকা, আর সকলে তা মাড়িয়ে যাচ্ছে- এই ছবি বাংলায় ভাইরাল হয়েছে ঝড়ের গতিতে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেল বহু ছবি-রিল, যা একইরকমের অসম্মানজনক। সেইসব ছবি-ভিডিও-রিলের মধ্যে কোনগুলি সত্যি আর কোনগুলি প্রযুক্তির সাহায্যে বানানো, তা না ভেবেই হু হু করে শেয়ার হল সেইসব। ততই বেড়ে উঠল বাংলাদেশের প্রতি পালটা ক্ষোভ। সে দেশ ও দেশবাসীকে অপমান, সে দেশের পতাকাকে অসম্মান করার দাবি ছড়াতে লাগল আরও দ্রুত। দুই দেশে প্রত্যক্ষ লড়াই না বাধুক, নেটযুদ্ধ কিন্তু বেধে গিয়েছে।
এর আগেও দাবি উঠেছে যে, ভারত বাঁধের জল ছেড়ে বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করছে। ক্রিকেট ম্যাচে ভারত জিতলে বাংলাদেশিদের একাংশ বিশ্বাস করে বসেছেন, আইসিসি-ই চোর। আবার বাংলাদেশে হিন্দু মন্দিরে কোরানের নিন্দা করার খবরও ছড়িয়েছে এই নেটদুনিয়াতেই। ফ্যাক্ট চেকিং যে হয়নি, হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু তার আগে অশান্তি পেকে যাচ্ছে ভালোমতোই। এমনকি সত্যি সামনে আসার পরেও অশান্তির আগুন পুরোপুরি থামছে না, কেননা নেটের দৌলতেই একটি খবরের ছড়িয়ে পড়া কখনোই পুরোপুরি থামিয়ে দেওয়া যায় না। সম্প্রতিই, খ্যাতনামা ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পল একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, আসল ইতিহাস আর হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। নেটের বাড়বাড়ন্ত তো রয়েছেই। সস্তা ও সুলভ ডেটা প্যাকের মতো গণতন্ত্র তো এখনও পর্যন্ত কোনও দেশ দিতে পারেনি। যে কেউ, কোনোরকম জ্ঞান বা যোগ্যতা ছাড়াই যে কোনও বিষয় নিয়ে যে কোনও পরিসরে মত প্রকাশ করতে পারে, এই আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। আর সেই ভারচুয়াল চণ্ডীমণ্ডপ বানানো তথ্য আর ইতিহাসের আঁতুড়ঘর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এর পাশাপাশিই আরও একটি বিষয়ের দিকে নজর টেনেছিলেন ডালরিম্পল। তা হল, প্রকৃত ইতিহাসের কারবারিদের সঙ্গে আমজনতার বিস্তর দূরত্ব। প্রকৃত ইতিহাস বা জ্ঞানের চর্চা গবেষকরা তো করবেনই, তাঁরা সেই বিষয়টি জানা-বোঝার মতো যোগ্যতা অর্জন করেছেন। কিন্তু সেই বিষয়টি যাদের অধিগত নয়, তাদেরকে তাদের মতো করে সহজে সেই ইতিহাস বোঝানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আর সেই ফাঁক দিয়েই হুহু করে বেড়ে উঠেছে হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির নকল জ্ঞানের আগাছা। ভাষা-সাহিত্যের তাত্ত্বিক পবিত্র সরকার যেমন বলছেন, “যারা মতলববাজ, তারা এই গুজবগুলিকে একটা শক্তিশালী ও অব্যর্থ অস্ত্র হিসেবে তৈরি করে আর ব্যবহার করে।” ভারত-বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাস বলায় ফাঁক রয়ে গিয়েছে বলেই সেই ফাঁকে যে গুজব জেগে উঠেছে, সেই ঘৃণার ইতিহাস শেষ পর্যন্ত বিপন্ন করছে সেই সাধারণ মানুষদেরই। তবে সেই বিপন্নতার ক্ষত কীভাবে সারবে, তার উপায় কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি কোনও দিনই বাতলে দিতে পারবে না।