কার সঙ্গে কার যুদ্ধ! কেনই বা যুদ্ধ! – এসব জানে না ওরা কেউ। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে যখন সকলেই প্রাণপন ছুটে চলেছেন, সেখানে ওদের কথা ভাবার মতো লোকের সংখ্যা নেহাতই কম। কী অবস্থায় আছে যুদ্ধক্লান্ত ইউক্রেনের চিড়িয়াখানা, অভয়ারণ্যগুলি? ইতিমধ্যেই রুশ বোমায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বহু চিড়িয়াখানাই। প্রাণ গিয়েছে অসংখ্য জীবজন্তুর। নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওদের কথা মনে রেখেছেন কয়েকজন। তাঁরা ইউক্রেনের জু মিলিটারি কমিউন। একদল স্বেচ্ছাসেবী যুবক, যারা যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই চেষ্টা করে চলেছেন অসহায় জন্তুজানোয়ারদের প্রাণ বাঁচাতে। সব বিপদ মাথায় করে তাঁদের অভিযান চলছেই। আসুন শুনে নিই, সেইসব ‘মসিহা’দের কথা।
সেই ‘লাইফ অব পাই’ ছবিটির কথা মনে আছে? চিড়িয়াখানার জীবজন্তুদের নিয়ে জাহাজে করে কানাডার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল একটি পরিবার। মধ্যরাতে আচমকা ঝড়ে ডুবে যায় জাহাজ। সমস্ত পশুপাখিরা তলিয়ে যায় সমুদ্রের গর্ভে। বেঁচে গিয়েছিল শুধু এক যুবক আর একটি ভয়ঙ্কর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। যেভাবে আচমকা ঝড় ডুবিয়ে দিয়েছিল এক জাহাজ ভর্তি পশুপাখিদের। কিছু বোঝার আগেই মৃত্যুর মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিলেন বেশ কয়েক জন ঘুমন্ত মানুষ আর এক জাহাজ জীবজন্তু।
এ-ও যেন তেমনই ঝড়। কিছু বোঝার আগেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান ঘোষণা করে দিল রাশিয়া। রাজায় রাজায় যুদ্ধ। এক নিমেষে দেশখানা যেন উল্টেপাল্টে গিয়েছে। যেদিকে তাকানো যায়, শুধুই ধ্বংসের ছবি। তার মধ্যেও হামলার ঝাঁজ বাড়িয়ে চলেছে রাশিয়া। উলুখাগড়ার মতো মানুষের প্রাণ তো যাচ্ছেই। কিন্তু এত সবের মধ্যে পড়ে কী অবস্থা হয়েছে ইউক্রেনের চিড়িয়াখানা বা অভয়ারণ্যের জীবজন্তুদের! সে কথা ভেবে দেখেছেন একবারও!
তবে ইউক্রেনে এখন যা পরিস্থিতি, তাতে পশুপাখিদের কথা ভাবার অবকাশ নেই কারওরই। যে যার প্রাণ হাতে করে দৌড়চ্ছে। দেশ ছেড়ে অন্যান্য দেশে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন হাজার হাজার ইউক্রেনবাসী।
আরও শুনুন: মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে! এই দ্বীপে বসবাস কয়েক হাজার বিড়ালের
প্রথম থেকেই রাশিয়ার সীমান্ত লাগোয়া খারকিভের উপর আঘাত হেনে চলেছে রুশবাহিনী। চলছে লাগাতার বোমা। ইতিমধ্যেই রুশ বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইউক্রেনের বহু ইকোপার্ক, চিড়িয়াখানা। খাঁচার ভিতরেই মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য পশুপাখির। খারকিভের কাছে ফেল্ডম্যান ইকোপার্কেও রয়েছে একটি চিড়িয়াখানা। যেখানে বসবাস ছিল বহু জীবজন্তুর। তবে পরের পর রুশ হামলায় মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত খারকিভ। ফলে চিড়িয়াখানার যে কী হাল, তা তো বলাই বাহুল্য।
সবাই প্রাণ ভয়ে পালাচ্ছেন বটে। তবে কেউ কেউ এমনও আছেন, যাঁরা ভোলেননি সে সব অসহায় সেসব পশুপাখিদের কথা। না, তাঁরা সরকার বা প্রশাসনের কেউ নয়। বরং তাঁরা সকলেই আম আদমি।
দেখতে দেখতে ৩২ দিনে পা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রাথমিক স্তরের লক্ষ্যপূরণ হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে মস্কো। পরবর্তীতে আরও তেজের সঙ্গে যুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ার বার্তাও দিয়েছে তারা। ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে পারমানবিক যুদ্ধের আশঙ্কা।
আরও শুনুন: যুদ্ধে তছনছ দেশ, ইউক্রেনের খুদেদের মুখে হাসি ফোটাল স্পাইডারম্যান
তবে এত সব যুদ্ধ, প্রাণভয়ের মধ্যেও পশুপাখিদের কথা ভাবতে ভোলেননি তারা। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে তেমনই এক ব্যক্তির মানবিকতার গল্প। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই চিড়িয়াখানার পশুপাখিদের ধাপে ধাপে ইউক্রেনের বাইরে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। নিজের প্রাণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তেমনই কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী। খুব সম্প্রতি আটটি ক্যাঙারুকে নিরাপদে ইউক্রেন থেকে বের করে আনতে সফল হয়েছেন তিনি। সেই ছবিই তিনি ভাগ করে নিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ইকোপার্ক কর্তৃপক্ষ বিশেষ ভাবে ধন্যাবাদ জানিয়েছেন ওই স্বেচ্ছাসেবী যুবককে। ওই ইকোপার্কে আটকে থাকা অন্যান্য জন্তুজানোয়ারদেরও উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন যুবক।
শুধু খারকিভই নয়, ইউক্রেনের বাকি চিড়িয়াখানাগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন সে সব চিড়িয়াখানায়। রাজধানী কিয়েভের চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এর মধ্যেও চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যাতে পশুপাখিদের নিরাপদে রাখা যায়। তবে তা কতদিন সম্ভব হবে তা জানেন না কেউই। কারণ মাথার উপর চক্কর কাটছে বোমারু বিমান। প্রতি মুহুর্তে আছড়ে পড়ছে গুলি, বোমা। তবে তার মধ্যেই নিজেদের কর্তব্য থেকে হঠছেন না ‘জু মিলিটারি কমিউন’। হ্যাঁ, ওই স্বেচ্ছাসেবী দলটি নিজেদের সেভাবেই পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। আপাতত ইউক্রেনের চিড়িয়াখানায় বন্দি পশুপাখিদের জন্য তাঁরাই সাক্ষাৎ ‘মসিহা’।