কানওয়ার যাত্রায় তীর্থযাত্রীদের মুসলিম ছোঁয়াচ থেকে বাঁচাতে তৎপর হয়েছিল একাধিক বিজেপিশাসিত রাজ্য। অথচ ৫ যাত্রী যখন জলে ডুবে মৃত্যুর মুখে, তাঁদের উদ্ধার করলেন যে কনস্টেবল, তিনি ধর্মে মুসলিম। জীবন যে আসলে ছোঁয়াছুঁয়ির ধর্ম মেনে চলে না, সে কথাই যেন প্রমাণ হল আরও একবার।
সমাজের যে কোনও ক্ষেত্রেই মানুষের একে অপরের সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে। সেই সহযোগিতার হাত অস্বীকার করলে আসলে জীবনের পথ চলাই কঠিন হয়। কানওয়ার যাত্রা নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিতর্কের মাঝেই সেই কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠল আরও একবার। যে মুসলিমদের ছোঁয়াচ বাঁচানো নিয়ে এত তর্কবিতর্ক চলছে, সেই ধর্মেরই একজন প্রাণে বাঁচালেন ৫ তীর্থযাত্রীকে। বুঝিয়ে দিলেন, মানুষের প্রাণ আসলে সব ধর্মীয় ভেদাভেদকে ছাপিয়ে যায় সবসময়েই।
আরও শুনুন:
গ্রামে নেই কোনও মুসলিম, গুজরাটের এই দরগা দেখভাল করেন হিন্দু ব্রাহ্মণরাই
কানওয়ার যাত্রার পথের ধারে সব দোকানের সামনে মালিকের নাম লিখতে হবে, যোগীরাজ্যের এই নির্দেশ ঘিরে বিতর্ক উসকে উঠেছিল সম্প্রতি। উত্তরপ্রদেশের পর উত্তরাখণ্ড, উজ্জ্বয়িনীতেও একই নির্দেশ জারি হয়েছিল। যদিও সুপ্রিম কোর্ট আপাতত এ নির্দেশে স্থগিতাদেশ দিয়েছে, তবে বোঝাই যায়, খাবারের দোকানের মালিকের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ্যে নিয়ে আসাই এই নির্দেশের উদ্দেশ্য ছিল। বুঝিয়েই দেওয়া হয়, যাতে মুসলিম দোকান থেকে হিন্দু তীর্থযাত্রীরা খাবার, চা, ফল কিছুই না কেনেন, তা-ই নিশ্চিত করতে চাইছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির বিজেপি সরকার। খোদ যোগী আদিত্যনাথ জানিয়ে দেন, তীর্থযাত্রীদের পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যেই এই সিদ্ধান্ত। সুপ্রিম নির্দেশ যতই সে পদক্ষেপকে স্থগিত করুক, ভেদাভেদের এই ভাবনা যে দেশে জেগে উঠেছে, তা আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না। ধর্মীয় পরিচয় এতটাই বড় হয়ে উঠেছে যে, একজন মানুষের ছোঁয়াচ মাত্রেই অশুচি, এমনটা ধরে নেওয়া হচ্ছে। অথচ সেই কানওয়ার যাত্রাই এবার দেখল, হর-কি-পৌরির কাছাকাছি কাংড়া ঘাটে যখন তলিয়ে যাচ্ছিলেন কোনও কোনও ভক্ত, তাঁদের উদ্ধার করেন SDRF কনস্টেবল আশিক আলি। হরিয়ানার ২১ বছরের মনু, তাঁরই সমবয়সি হরিদ্বারের গোবিন্দ সিং, গোরখপুরের সন্দীপ সিং, পানিপথের ১৫ বছরের অঙ্কিত, দিল্লির ১৭ বছরের করণ- সকলেই প্রাণ ফিরে পেয়েছেন আশিকের দৌলতে। প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলেন এই ভক্তরা। নিজের ভালোমন্দের তোয়াক্কা না করেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের উদ্ধার করেছেন তিনি। তবে তার জন্য আলাদা করে কৃতিত্ব নিতে তিনি নারাজ। নারাজ ধর্মপরিচয় নিয়ে মাথা ঘামাতেও। আমার কাছে সকলেই মানুষ আর মানুষের প্রাণ বাঁচানোই আমার ধর্ম, বলছেন আশিক।
আরও শুনুন:
পুণ্যলাভ হিন্দুদের, তবু অমরনাথ যাত্রা শুরু হলেই কেন হাসি ফোটে মুসলিমদের মুখে?
আসলে তো সত্যিই এমন ঘটনায় উদ্ধারকারী কিংবা বিপন্ন, কারোরই ধর্ম দেখার কথাই নয়। একজন মানুষ অন্য কোনও মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, প্রাণ বাঁচিয়েছেন, এ দৃশ্যের চেয়ে সুন্দর আর কী-ই বা হতে পারে! তবুও, সাম্প্রতিক কালে যে কোনও মুহূর্তকেই ধর্ম দিয়ে বিচার করে চলেছে এ দেশ। ধর্মের বেড়া টেনে ক্রমশ আলাদা হয়ে যাচ্ছে মানুষ থেকে মানুষ। হাত ছেড়ে যাচ্ছে তাদের। তাই সেই বিচ্ছিন্নতার সময়ে সব জুড়ে থাকার গল্পও বলে যেতে হয় বইকি। বলে যেতে হয়, কোথায় ভাগ না করে যোগ করার ধর্ম পালন করেছে মানুষ। সেই তালিকাতেই এবার যোগ হয়ে গেল আশিক আলির কথাও।