রাজনৈতিক বার্তা দিচ্ছেন প্রবীণ নেতা। তবে নিজে নন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে নির্মিত হয়েছে সেই বক্তব্য। সম্প্রতি বঙ্গ রাজনীতি এর সাক্ষী থেকেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেতাদের দর্শন থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেবে না তো? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
প্রযুক্তি কি রাজনীতির যুক্তি মানবে? নির্ভর করছে, কে কীভাবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে তার উপর। সম্প্রতি ভোটের আবহে রাজ্যবাসীর উদ্দেশে রাজনৈতক বার্তা দিতে শোনা গেল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। তবে তিনি স্বকণ্ঠে কিছু বলেননি। এখানেও নেপথ্যে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সেই ভিডিও যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে রাজনৈতিক মহলে। তা দেখে অনেকে যেমন আবেগে আপ্লুত হয়েছেন, তেমনই কেউ কেউ ভিডিওটি আদৌ দরকার ছিল কি-না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ভিডিওটিতে বুদ্ধবাবুর মুখে যে কথা শোনা যাচ্ছে তা কোনও ভাবেই রাজনৈতিক পরিসরের বাইরে নয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে, বক্তব্য তাঁকে শুনিয়ে নেওয়ার অবকাশ আছে। কিছুদিন আগে শোনা গিয়েছিল যে, কংগ্রেসও এরকম পরিকল্পনা নিয়েছে। গান্ধী ও নেহরুর বক্তব্য এআই ব্যবহার করে ফিরিয়ে আনা হবে ভোটের আবহে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে ভোটের প্রচারকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চাইছে, তার একটা ইঙ্গিত মেলে এই ধরনের সিদ্ধান্তে।
বর্তমানে এআই-এর প্রয়োগ যেভাবে বাড়ছে, তাতে নির্বাচন বেশি দূরে থাকতে পারে না। স্বাভাবিক ভাবেই তা হচ্ছে। সেই সঙ্গে থেকে যাচ্ছে কয়েকটি শঙ্কার জায়গাও। প্রশ্ন হল, প্রযুক্তির এই ব্যবহার কতটা যুক্তিযুক্ত? আর তা যদি ক্রমাগত সব দল করতে থাকে, নেতাদের বক্তব্য যদি প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে ওঠে, আখেরে বিপদ বাড়বে না তো? এইআই ব্যবহার নিয়ে এই বিতর্ক প্রথম উঠেছিল বিনোদন জগতে। প্রয়াত শিল্পীদের কণ্ঠস্বর ব্যবহার করা হচ্ছিল সেখানে। নতুন শিল্পীদের গান শোনা যাচ্ছিল তাঁদের কণ্ঠে। প্রশ্ন উঠছিল, যদি প্রযুক্তির এই ধরনের ব্যবহারই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, তাহলে তো যে কোনও সিনেমার সিচুয়েশনে প্রয়াত শিল্পীদের দিয়েই গান গাইয়ে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! তার থেকেও বড় কথা, এই কাজ কি নীতিগত ভাবে আদৌ ঠিক? যে শিল্পীর কণ্ঠস্বর ব্যবহৃত হচ্ছে, আদৌ সেই গানটি তিনি গাইতে চাইতেন কি-না, তা জানার তো কোনও উপায় থাকছে না। অর্থাৎ মূল বিষয়টি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল নৈতিকতার প্রশ্নে। রাজনীতিতে এই একই প্রযুক্তির ব্যবহার সেই প্রশ্নেই পৌঁছে দিয়েছে।
আরও শুনুন: মাছ, মঙ্গলসূত্র, মন্দিরেই কথা শেষ! ৬.৫ লক্ষ শব্দের প্রচারে ‘চাকরি’ কোথায়? প্রশ্ন মোদিকে
এখানে যেমন বার্তা দেওয়া যাচ্ছে, তেমন একটা অন্য সম্ভাবনা থেকে যায়। একজন নেতার কথা বলার ভঙ্গিটি নিশ্চয়ই প্রযুক্তির মাধ্যমে রিক্রিয়েট করা যায়। তাঁর বক্তব্য কী হতে পারে, তাও অনুমান করা যায়। তবে, একটা নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি যে সেই কথাটিই বলতেন, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। তিনি কী শব্দ প্রয়োগ করতেন তাও নির্ভর করছে, প্রযুক্তিকে কী শব্দ শেখানো হচ্ছে তার উপর। আদৌ তিনি এই শব্দগুলিই প্রয়োগ করতেন কি-না, তাও বলা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলি যদি এটিকে প্র্যাকটিসের মধ্যে নিয়ে চলে আসে, তাহলে হয়তো এমন অনেকের নেতার কথাই ভবিষ্যতে শোনা যাবে, যা কল্পিত। অর্থাৎ তিনি তা আদৌ বলতেন কি-না, তা মিলিয়ে নেওয়ার কোনও উপায় থাকবে না। কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলে থাকেন, যদি অমুক নেতা থাকতেন তাহলে হয়তো এই কথা বলতেন। এআই ভিডিও-র দৌলতে এই ‘হয়তো’ বা সম্ভাবনা আর থাকছে না। সেক্ষেত্রে নেতার মুখে সরাসরি যে কথা বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তরুণ প্রজন্মের কাছে সেটাই নেতার বক্তব্য হিসাবে প্রতিভাত হবে। অর্থাৎ একজন নেতা কী বলতে পারেন বা পারতেন, তা ছিল রাজনৈতিক চর্চার বিষয়। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদ সম্পর্কে গভীর পড়াশোনা না থাকলে তা বলা যায় না। বলার সময় তথ্যসূত্রের উল্লেখ থাকা জরুরি। এখন ভিডিও-র দৌলতে তা হাতে চলে আসছে ইনস্ট্যান্ট। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে, তা মিলিয়ে দেখার কষ্ট আর কেউ করছেন না। অনেক বড় মানুষের জীবনেই এমন অনেক কথা পাওয়া যায়, যা পাশাপাশি বসালে মনে হাতে পারে স্ববিরোধী। তবে তাঁর সামগ্রিক জীবন ও দর্শন যদি কেউ ভালো করে খতিয়ে দেখেন, তাহলে একটা ধারাবাহিকতা টের পাওয়া যায়। এক ধরনের ভাবনা থেকে কেন অন্য ধরনের ভাবনায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন, একমাত্র তখনই তা বোঝা যায়। নইলে কেবল একটা উদ্ধৃতি প্রেক্ষিতহীন ভাবে ব্যবহার করলে যা হওয়ার হয়, এক্ষেত্রেও তাই-ই হবে। তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন হয়তো করতে পারে, তবে তা যে সেই ব্যক্তির সামগ্রিক দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হবে, তা বলা যায় না। এইখানেই গোলমালের সূত্রপাত। যে কোনও রাজনৈতিক দল তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কোনও মনীষীর একটি কথাকে এভাবে এইআই ভিডিও-র মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারে। আবার তার পালটাও দিতে পারে অন্য রাজনৈতিক দল। প্রযুক্তির ব্যবহার সেই সম্ভাবনা খুলে দিচ্ছে বেশ ভালো ভাবেই। তবে তাতে রাজনৈতিক দর্শনের এলোমেলো হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। একজন নেতা বা বড় মানুষকে সামগ্রিক ভাবে না জেনে, তাঁর একটি কথাকেই প্রেক্ষিতহীন ভাবে অকাট্য ভেবে বসতে পারেন অনেকেই। তা ছাড়া এই কাজ আদৌ করা যায় কি না, করলেও কাকে কাকে নিয়ে করা যায়, তা বিচার করতে বসলে আইনি জটিলতার প্রসঙ্গটিও চলে আসে।
প্রযুক্তির ব্যবহার আটকে রাখা যায় না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও যে ভোটের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা সময়েরই দাবি। তবে তা অনেক জটিলতার দরজাও খুলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে যদি প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে থাকে, তবে অপব্যবহারের সম্ভাবনাও থাকে। সেক্ষেত্রে একজন নেতার মতবাদ বা মনীষীর দর্শন থেকেই একটা দূরত্ব তৈরি হওয়ার জায়গা থাকে। যার দরুন ভ্রান্ত মতবাদও তৈরি হতে পারে, এমনকী ছড়িয়েও যেতে পারে। ভোটের আবহে প্রযুক্তির ব্যবহারে সেই আশঙ্কাটুকু কিন্তু থেকেই যায়।