এক পড়ুয়া বাড়ির কাজ করেনি বলে শিক্ষিকার নিদান, অন্য সহপাঠীরা একযোগে তার গায়ে হাত তুলুক। আবার খেলতে গিয়ে ফুটবল ফাটিয়ে ফেলেছে বলে পড়ুয়াদের দুদিন অনাহারে রাখার শাস্তি দিচ্ছে এক স্কুল। সম্প্রতি যে র্যাগিং-এর প্রবণতা নিয়ে এত কথা চলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এইসব শাস্তির মধ্যেও কি রয়ে যাচ্ছে তেমনই কোনও মনোভাব? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
কয়েকদিন আগেই রণে বনে জলে জঙ্গলে সব আলোচনায় একটিই বিষয় উঠে আসছিল, র্যাগিং। কয়েকজন সিনিয়র পড়ুয়ার র্যাগিং-এর জেরে এক জুনিয়র পড়ুয়ার অসহায়তা এবং সেখান থেকে মৃত্যু, এই ঘটনা সকলকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। অভিযুক্তদের কড়া শাস্তির দাবিতে সরব হয়েছিলেন সকলেই। তবে কেউ কেউ এর মাঝেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, প্রতিকার চাওয়ার থেকে প্রতিশোধ চাওয়াই কি বড় হয়ে উঠছে এখানে? কোনও সমস্যার প্রতিকার চাইতে হলে সেই সমস্যার উৎসটিকেও তো খতিয়ে দেখতে হয়, তা কি আদৌ করছি আমরা? সত্যিই যদি র্যাগিং-এর মতো একটি রোগ থেকে রেহাই পেতে হয়, তাহলে এই রোগের গোড়ায় পৌঁছনো দরকার। কারণ, যে পড়ুয়ারা তাদের থেকে বয়সে ছোট, নতুন পড়ুয়াটিকে উত্যক্ত করার মধ্যে আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে, তারা তো আমাদের বাড়ি কিংবা পাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই। ফলে আমরা-ওরা বিভাজনের কোনও জায়গাই নেই এখানে। তাহলে কি ভূত সর্ষের ভিতরেই? অর্থাৎ, যে পরিবেশ তাদের দেওয়া হয়েছে, তাই কি এতখানি অপরাধপ্রবণ, যে সেই অন্ধকারে ছেয়ে আছে তরুণদের মন ও মনন? সাম্প্রতিক কালে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটতে থাকা কিছু ঘটনায় সেই প্রশ্নই যেন আরও একবার উসকে উঠল।
আরও শুনুন: ধর্ষণের ঘটনাতে সায় মহিলাদেরও! অরুন্ধতী বলছেন, আমাদের এখন ‘গভীর অসুখ’
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তরপ্রদেশের একটি বেসরকারি স্কুলের ভিডিও। যেখানে দেখা গিয়েছিল, একটি শিশু পড়া পারেনি বলে শিক্ষিকা চেয়ারে বসে এক এক করে ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের ডাকছেন, তারা এসে শিশুটিকে মেরে যাচ্ছে। উঠছে হাসির রোল এবং শোনা যাচ্ছে শিক্ষিকার সংখ্যালঘুবিদ্বেষী কথাবার্তা। ওই শিক্ষিকার দাবি, শিশুটি পড়াশোনা করছে না, বাড়ির কাজ করে আনছে না, তাই এহেন শাস্তির ব্যবস্থা। এই ঘটনার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই সামনে এল ছত্তিশগড়ের এক আবাসিক স্কুলের ঘটনা। সেখানে খেলতে খেলতে ফুটবল ফাটিয়ে ফেলেছিল পড়ুয়ারা। তার শাস্তি হিসেবে তাদের দু’দিন অনাহারে রাখার নিদান দেন স্কুলের সুপার। তাঁর বক্তব্য, ভুল করলে কী শাস্তি পেতে হবে, পড়ুয়াদের তা টের পাওয়ানোর জন্যই এমন কাজ করেছেন তিনি। অর্থাৎ দু ক্ষেত্রেই যাঁরা পড়ুয়াদের একরকম নির্যাতন করছেন, তাঁদের বক্তব্য, পড়ুয়াদের ভালর কথা ভেবেই এ কাজ করছেন তাঁরা। এবার কথা হল, যারা র্যাগিং করে থাকে, তাদের মুখেও কিন্তু হরদম এমন অজুহাতই শোনা যায়। তাদের দাবি, র্যাগিং করলে জীবনের লড়াইটা লড়তে শেখে নবীন পড়ুয়ারা। অথচ নির্যাতন যে কোনোভাবেই কারও ভাল করতে পারে না, সে কথা তো বারে বারেই বলে থাকেন মনোবিদেরা। সেইসব দিক ভেবে দেখেই শিক্ষাক্ষেত্রে কর্পোরাল পানিশমেন্ট নিষিদ্ধ করেছে ভারতীয় আইন। অথচ দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই সে বিষয়টি নিয়ে ধারণা নেই।
এই যে ধারণা না থাকা, কিংবা থাকলেও তা নিয়ে মাথা না ঘামানো- এর মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আরও একটি বিষয়। তা হল ক্ষমতার ভাষা। যাকে নির্যাতন করা হচ্ছে, সামাজিক ক্ষমতার অবস্থানে সে নির্যাতকের চেয়ে কমবেশি নিচের ধাপে রয়েছে। বয়সের দিক থেকেও সে ছোট। সুতরাং ইচ্ছে হলে তাকে মৌখিক বা শারীরিক নির্যাতন করা যেতে পারে, এমন একরকম লাইসেন্স অলিখিতভাবেই রয়ে গিয়েছে যেন। স্কুলে শাস্তি দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠলে এখনও অনেককেই বলতে শোনা যায়, মার না খেলে নাকি কেউ মানুষ হয় না। অর্থাৎ এই বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু কেবলমাত্র শাস্তির ভয় দেখিয়ে যে কারও মধ্যে স্থায়ী বদল আনা যায় না, সে দিকটি অবহেলিতই রয়ে গিয়েছে। উলটে যে এই নির্যাতনের মুখে পড়ছে, তার কাছে এমন একটি ধারণা তৈরি হচ্ছে যে, উলটো দিকের অবস্থানে পৌঁছলে সেও কাউকে শাস্তি দিতে পারবে। বস্তুত, কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে র্যাগিং-এর অভিযোগ উঠছে, সেখানে র্যাগিং করতে দেখা যাচ্ছে সিনিয়র পড়ুয়াদের, এবং র্যাগিং-এর শিকার সদ্য ভরতি হওয়া জুনিয়রেরা। আবার এও শোনা যাচ্ছে যে, র্যাগড হওয়া জুনিয়রেরাই সিনিয়র হওয়ার পর অবতীর্ণ হচ্ছে র্যাগার-এর ভূমিকায়।
আরও শুনুন: যত কাণ্ড যাদবপুরে! অভিযোগের ঠেলায় আসল প্রশ্নগুলোই চাপা পড়ছে না তো?
সব মিলিয়ে একটি কথাই বোধহয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ। কেবলমাত্র একটি ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে আর সেই ঘটনায় শাস্তি দিলেই যে সমস্যার সমাধান হবে, এমনটা নয়। কারণ এই সমস্যা আসলে সর্বস্তরেই ছড়িয়ে রয়েছে। সমাজের হায়ারার্কির সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জুড়ে গিয়েছে ক্ষমতা অনুযায়ী নির্যাতনের চিত্রটাও। যে পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে র্যাগিং-এর অভিযোগ উঠছে, তাদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাই শিক্ষাক্ষেত্রের কর্তৃপক্ষের মনোভাবটিও খতিয়ে দেখা জরুরি। র্যাগিং রোগের বীজ সেখানেই খানিক লুকিয়ে রয়েছে কি না, সে কথাই এবার ভেবে দেখা দরকার।