একদিকে ‘মোদি মোদি’ রব। অন্যদিকে পালটা ‘জোড়ো জোড়ো… ভারত জোড়ো’। বাজেট পেশের সূচনায় যে দুই স্লোগানের সাক্ষী থাকল দেশবাসী, তা যেন আদতে দুই ভারতের গল্প। কেমন সেই দুরকম ভারত? আসুন শুনে নিই।
রাহুল গান্ধীর ভারত-জোড়ো-যাত্রা কি দশের রাজনৈতিক ন্যারেটিভে কোনও প্রভাব ফেলবে? যাত্রায় অসংখ্য মানুষের অংশগ্রহণের পরেও এই প্রশ্ন জেগে ছিল রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মনে। বাজেট পেশের সময় সেই ‘ভারত জোড়ো’ যখন মোদির নামের স্লোগানের পালটা হয়ে উঠল, তখন নিশ্চিত ভাবেই তা খুলে দিল নতুন ভাবনার পথ।
আরও শুনুন: মোদির মুখে প্রথম শোনা, বাজেট বক্তৃতায় বললেন অর্থমন্ত্রীও, কী এই ‘অমৃত কাল’?
বুধবার নির্মলা সীতারমণের বাজেট পেশের সময়ই একদিক থেকে ভেসে আসে ‘মোদি মোদি’ স্লোগান। বিজেপির লোকসভার সদস্যরাই এই ধ্বনি তোলেন। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, কক্ষের অন্য দিক অবশ্য নিস্তব্ধ ছিল না। আবার যেমন তেমন কথা বলে হট্টগোলেরও জন্ম দেয়নি। বরং একটা সম্মিলিত স্বরেই পালটা স্লোগান দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ‘মোদি মোদি’র পালটা হিসাবে কংগ্রেসের তরফে তোলা হয় ‘জোড়ো জোড়ো…ভারত জোড়ো’ স্লোগান। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এ কোনও আচমকা উত্তর দেওয়ার ঘটনা নয়। বরং ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে স্পষ্ট যে, শাসকদলকে পালটা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল বিরোধীপক্ষ। বাজেট অধিবেশন যে নানা ইস্যুতে উত্তপ্ত হতে চলেছে তার আঁচ অবশ্য আগেই পাওয়া গিয়েছিল। রাজনাথ সিং-এর নেতৃত্বে গত সোমবার যখন সর্বদলীয় বৈঠক হয়, তখনই একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে এসেছিল সরকারের দিকে। সেখানে মূল বিষয় ছিল দুটি, আদানির সম্পত্তি নিয়ে প্রশ্ন এবং বিবিসি-র তথ্যচিত্র নিয়ে সরকারের পদক্ষেপের বিরোধিতা। একাধিক বিরোধী দল একজোট হয়ে এ নিয়ে আওয়াজ তুলেছিল। ফলে বাজেট অধিবেশন যে এই নিয়ে উত্তাল হবে, তার আভাস মিলেছিল। বুধবার বাজেট পেশের সময়কার স্লোগান ও পালটা স্লোগানকে তারই নান্দীমুখ বলা যায়।
আরও শুনুন: কারও সর্বনাশ তো কারও পৌষ মাস! আদানিকে টপকে দেশের ধনীতম এখন আম্বানিই
বিরোধীদের, বলা ভালো কংগ্রেসের পালটা দেওয়ার এই প্রস্তুতি পর্বের সূচনাটা অবশ্য বেশ কিছুদিন আগেই। রাহুল গান্ধী যখন ভারত-জোড়ো যাত্রায় নামলেন, ঠিক তখনই। সদ্যই কাশ্মীরের লালচকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে যাত্রার প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন রাহুল। তবে এর মধ্যেই এই যাত্রা বড় একটা প্রভাব ফেলেছে দেশবাসীর মনে। ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালবাসা- এই মন্ত্র নিয়ে পথ হেঁটেছেন রাহুল। তাঁর চেহারা দেখে বিশেষজ্ঞরা বলেছেdesher ন, যেন কোনও ফকির হেঁটে চলেছেন। এই ‘ফকির’ শব্দটিই একসময় তাঁর বক্তব্যে তুলে এনেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, দেশের স্বার্থই তাঁর কাছে সবার উপরে, নইলে তো তিনি ফকির মানুষ, যে কোনও দিন ঝোলা কাঁধে যে কোনও দিকে চলে যেতে পারেন। যাত্রাপথে রাহুলের চেহারা যেন নীরবেই সেই রাজনৈতিক বয়ানের একটা পালটা বয়ান হয়ে উঠেছিল। বাজেটের সূচনায় দেখা গেল, শুধু নীরব-বার্তা নয়, বিরোধী পক্ষের মুখে প্রতিস্পর্ধী এক স্লোগানও তুলে দিতে পেরেছেন তিনি।
দেশের মাটিতে ভারতীয় জনতা পার্টির যে বর্তমান সাফল্য, তার অন্যতম কাণ্ডারী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিজেপির বিজয়রথ ছুটেছে মোদিকে মুখ করেই। এবং আগামী দিনেও তুরুপের তাস তিনিই। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা প্রায়শই বলে থাকেন, যেন দুরকম ভারতবর্ষ আছে এই দেশের অন্দরে। একদিকে ঝাঁ চকচকে ‘ইন্ডিয়া’, অন্যদিকে দারিদ্র্যক্লিষ্ট, উচ্ছিন্ন ‘ভারত’। রাজনৈতিক মতাদর্শের ক্ষেত্রেও এ কথা বলাই যায়। একদিকে নিজের মতো করে এগিয়ে চলেছে মোদির ভারত। আর সেই ‘অগ্রগতি’কে এগিয়ে যাওয়া বলতে নারাজ আর-এক ভারতবর্ষ। সে ভারতবর্ষ বলে, মৌলিক অধিকার হরণ হচ্ছে মানুষের, ক্ষুণ্ণ হচ্ছে সংবিধানের মর্যাদা, বিকৃত হচ্ছে দেশের ইতিহাস। রাজনৈতিক বিরোধীরাও সে কথা বলেন বটে, কিন্তু তাঁরা বহু ভাগে খণ্ডিত। পরস্পর হাতে হাত রাখতে দ্বিধান্বিত। ফলত যেভাবে একদিকের ভারতবর্ষ মোদির নামে জয়ধ্বনি করে, অন্যদিকের ভারতবর্ষ তা পারে না। কেননা সম্মিলিত কোনও স্বর নেই সেভাবে। বুধবারের বাজেট সূচনায় স্লোগানযুদ্ধ দেখাল, সেই স্বর যেন একটু হলেও স্পষ্ট হয়েছে। ‘ভারত-জোড়ো’ স্লোগান ‘মোদি-মোদি’ স্লোগানের প্রতিবয়ান হয়ে উঠতে পেরেছে।
তাতে কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট বদল আসবে? এখনই তা বলা যায় না অবশ্য। আদৌ কংগ্রেস, বিজেপির ভোট-অঙ্কের হিসাবে প্রভাব ফেলতে পারবে কি না, সে উত্তর সময়ের কাছেই তোলা আছে। তবে এদিনের আভাস এটুকু নিশ্চিতই বলে যে, বিরোধী তার স্বর খুঁজে পেয়েছে। বিচ্ছিন্নতার বিপ্রতীপে জুড়ে থাকার কথা সোচ্চারেই বলে উঠতে পেরেছে। দেশের গণতন্ত্রের জন্য যে এই পরিসর অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর, এ কথা বোধহয় বলাই যায়।