“মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়।”- আর এর থেকে বড় সত্যি বোধহয় হয় না। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে অন্তত সেই কথাই আরও একবার প্রমাণ করলেন সেখানকার নাগরিকেরা। শত্রুদেশের সেনাদের প্রতি যে সৌজন্য তাঁরা দেখাতে পেরেছেন, তাই বোধহয় যুদ্ধবাজদের প্রতি যথার্থ মানবিক উত্তর! কী করেছেন তাঁরা? শুনে নিন সেই ঘটনাই।
যুদ্ধের আগুনে ছারখার গোটা দেশ। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক অভিযান ঘোষণা করার পর থেকে কেটে গিয়েছে প্রায় আট দিন। একের পর এক বোমা, বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সাজানো-গোছানো দেশটা। মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য মানুষের। মাথার উপর চক্কর কাটছে শত্রুদেশের যুদ্ধবিমান। একের পর এক বোমা নেমে আসছে শহরের বুকে। পাল্টা আক্রমণ হানছে ইউক্রেনও। ইউক্রেনের হাতে ধরা পড়ছে রুশ সেনা। রক্ত, মৃত্যু, গোলাগুলি, বন্দুক- এটাই এখন একমাত্র ছবি ইউক্রেন জুড়ে।
যুদ্ধ তো আসলে মানবতা-বিরোধী। সমস্ত রকম ভালো, শুভ-র বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। দেশ জুড়ে খাবারদাবারের সংকট, চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা, তবু মানবতা হারেনি ইউক্রেনে। আর তার নজিরই বোধহয় রাখলেন দেশের আম আদমিরা। হ্যাঁ তাঁরাই, যারা ‘রাজায় রাজায়’ যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে উলুখাগড়ার মতোই প্রতিদিন শেষ হয়ে যাচ্ছেন তিলে তিলে।
আরও শুনুন: যুদ্ধ এড়াতে আফগানিস্তান ছেড়ে ইউক্রেনে ঠাঁই, ফের যুদ্ধই ঘরছাড়া করল আজমলদের
দিন কয়েক আগেই এক রুশ সেনার শেষ চিঠি প্রকাশ্যে এসেছিল। মৃত্যুর আগে মাকে লেখা সেই চিঠিতে নিজের ভয়ের কথা বলেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, নিরপরাধ মানুষকেও হত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন। নিজের অসহায়তার কথা সেই চিঠিতে ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। যা দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল নেটবিশ্ব। এর পরে প্রকাশ্যে এল এমন একটি ঘটনার ভিডিয়ো, যা সত্যিই এত হিংসা, হানাহানির মধ্যেও ভরসা জোগায়।
রুশ সেনার হাতে যেমন অসংখ্য ইউক্রেনবাসীর মৃত্য়ু হচ্ছে, তেমনই উল্টোদিকে এ দেশে এসে ধরা পড়ছেন হাজার হাজার রুশ সেনা। ইউক্রেন সেনার হাতে তো বটেই, মাঝেসাঝে নাগরিকেরাও পাকড়াও করছেন তাঁদের। তেমন ভাবেই বেশ কয়েকজন বাসিন্দার হাতে বন্দি হন এক রুশ সেনা। শত্রুদেশের সেনা, ঘাতক হয়ে উঠতে পারে যে কোনও সময়! তা জানা সত্ত্বেও সেই ব্যক্তির প্রতি কোনওরকম হিংসা বা দ্বেষ দেখাননি তাঁরা। বরং তাঁকে বসিয়েছেন, চা-জল-খাবার খাইয়েছেন। আশ্বস্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, বন্দি রুশ সেনার মাকে নিজেদের মোবাইল থেকে ভিডিয়ো কল করে জানিয়েছেন, সুস্থ আছেন তাঁদের ছেলে। নিরাপদে রয়েছেন।
আর যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনবাসীর এই সৌজন্যে কেঁদে ফেলেছেন ওই রুশ সেনা। তাঁর দেশ ইউক্রেনবাসীর বিরুদ্ধে যে হিংসা দেখিয়েছে, তা সত্ত্বেও মানবিকতা ভোলেননি এ দেশের নাগরিকেরা। বন্দি ওই সেনার সঙ্গে তাঁরা যে ব্যবহার করেছেন তাতে তিনি আপ্লুত। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রকের তরফেও সম্প্রতি জানানো হয়েছে, সে দেশে আটক রুশ সেনাদের মায়েরা যেন কিয়েভে এসে তাঁদের সন্তানদের ফেরত নিয়ে যান। এর জন্য একটি বিশেষ মেল আইডি ও হেল্পলাইন নম্বরও দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে। প্রথমে থেকেই ইউক্রেনে আটক রুশ সেনাদের প্রতি সৌজন্য দেখিয়ে এসেছে কিয়েভ। তাঁদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে এমন বেশ কিছু ভিডিও। পুতিনের এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে গণজাগরণের প্রয়োজনীয়তা কতখানি, সে সম্পর্কে নিজের মাকে জানিয়েছেন এক বন্দি রুশ সেনা। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আরও শুনুন: ‘ভয় করছে’, মাকে শেষ মেসেজে জানিয়েছিলেন নিহত রুশ সেনা
কয়েকটি সূত্রের দাবি, বহু রুশ সেনার পরিবারের লোকেরা জানেনই না, যে তাঁদের ছেলেকে ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অনেকেরই বয়স নেহাত কম। সকলের সেনা প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ হয়েছে তেমনও নয়। অথচ সেই আনকোরাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে যুদ্ধ করতে। আসলে, তাঁরাও জানেন, এ সাক্ষাৎ মৃত্যুর ফাঁদ। ইউক্রেন প্রশাসনের মতে, এখনও পর্যন্ত যু্দ্ধ করতে এসে ইউক্রেনে মৃত্যু হয়েছে ন-হাজার রুশ সেনার। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত সেনাদের দেহ পর্যন্ত তুলছে না তারা, পরিবারের কাছে পাঠানো বা সৎকার তো দূরের কথা। বেশ কয়েকটি সূত্র অনুযায়ী, ইউক্রেনে ভয়ঙ্কর খাদ্যাভাবে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ ভয়াবহ। আর এমন পরিস্থিতিতেও ইউক্রেনবাসী যে ভাবে মানবিকতার নজির রেখেছেন, তাকে কুর্নিশ করা ছাড়া আর কোনও পথ নেই বলেই মত নেটদুনিয়ার।