অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু হলে বদলে যাবে মুসলমান সমাজের নিজস্ব নিয়মকানুন। এই অভিযোগে সরব মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড। একই সঙ্গে ব্যক্তিগত বিধির বৈচিত্র বজায় রাখার পক্ষেও সওয়াল হচ্ছে। ঠিক এই প্রেক্ষিতে ইসলাম-প্রধান দেশগুলি এক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে এই মুহূর্তে দেশে তুঙ্গে বিতর্ক। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের অন্যতম ইস্যু হয়ে উঠতে চলেছে অভিন্ন বিধি। ইতিমধ্যেই এই বিধির পক্ষে সওয়াল করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর মত, গোটা দেশকে যদি এক পরিবার হিসাবে কল্পনা করা হয়, তবে সকলের জন্য আলাদা নিয়ম জারি থাকা উচিত নয়। অন্যদিকে, ব্যক্তিগত বিধিতে বৈচিত্র থাকা উচিত বলেই মত অনেকের। বিরোধীরাও এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মতের বিরোধিতা করেছেন। আবার বর্তমান আইন কমিশনের খসড়া আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোনও কোনও বিরোধী শিবির।
আরও শুনুন: ‘মুসলিমদের বৈষম্যকে তোপ, হিন্দুদের জাতপাত নিয়ে চুপ কেন?’ UCC ইস্যুতে মোদিকে খোঁচা সাংবাদিকের
তবে এই ইস্যুতে বিরোধিতায় সবথেকে সোচ্চার অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড। ইতিমধ্যেই আইন কমিশনের কাছে সংগঠনের পক্ষ থেকে তাদের আপত্তির কথা সবিস্তারে জানানো হয়েছে। এখানে সবথেকে জোরালো মত যা, তা হল, অভিন্ন বিধি লাগু হলে মুসলিমদের সত্তাগত পরিচয়েই আঘাত আসবে। কেননা ব্যক্তিগত আইন আর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পরিচিতি-সত্তা এক সুতোয় বাঁধা। এই বিতর্কের অবসান কোন পথে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে এই আবহে জেনে নেওয়া যেতে পারে, ইসলাম-প্রধান দেশগুলি এক্ষেত্রে ঠিক কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নিজস্ব আইনের ক্ষেত্রে বদল আনা বহু ইসলাম-প্রধান দেশের কাছেই সমস্যার হয়ে উঠেছিল। তবে, সেই সংকট মোকাবিলারও চেষ্টা করেছে দেশগুলি। পাকিস্তানের দিকেই তাকানো যাক। ‘মুসলিম ফ্যামিলি ল অর্ডিন্যান্স ১৯৬১’-এর আওতায় সে-দেশেও মুসলিমদের ব্যক্তিগত আইনে বেশ কিছু বদল আনা হয়েছিল। বিশেষত মুসলিমদের বৈবাহিক সম্পর্ক, পুরুষদের বহুগামিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ‘বৈপ্লবিক’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী ক্ষেত্রে সরকার বদল হলেও এই সংস্কারমূলক পদক্ষেপ কিন্তু পালটে দেওয়া হয়নি। ২০০০ সালে ইজিপ্টেও এই ধরনের সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে বিয়ের ন্যূনতম বয়স এক রাখা হয়। তিক্ত বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ‘খুলা’র অনুমোদন দেওয়া হয় নারীদের। এ ছাড়া নারীদের অর্থনৈতিক দিকটি সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারেও নজর দেওয়া হয়েছিল সেই সংস্কারে। তিউনিসিয়ার ক্ষেত্রেও একই জিনিস দেখা যায়। আদালতের মাধ্যমেই বিবাহবিচ্ছেদ, নারীদের ‘খতনা’ প্রথা বন্ধ ইত্যাদির মতো জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
আরও শুনুন: গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর সামনে বাধা তাঁর ভক্তরাই! কোথায় সমস্যায় পড়ছেন স্বয়ং মোদি?
অর্থাৎ ইসলাম-প্রধান দেশগুলিও বিভিন্ন সময় ব্যক্তিগত আইন সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সময় বদলের সঙ্গে এই বিধি বদলেরও যে প্রয়োজনীয়তা আছে, এই পদক্ষেপ যেন সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। অভিন্ন বিধির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী যখনই সওয়াল করছেন, তখন এই সংস্কারের প্রতিই ইঙ্গিত করছেন। অন্যদিকে গড় ছাঁচে সকলকে ফেলতে গেলে যে কোথাও কোথাও জাতিসত্তার নিরিখে টানাটানি পড়বে, সে সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়নি। তবে ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে আলোচনার মাধ্যমেই যে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে, সে ভরসা করাই যায়। আগামীতে হয়তো সেই সমাধানের পথটিই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।