নির্বাচন এসে হাজির হলেই হঠাৎ রঙিন হয়ে ওঠে চারপাশ। নতুন পুরনো ভাঙাচোরা সব দেওয়ালে নতুন করে লাগে সাদা রঙের পোঁচ। আর সেই সাদা রঙের ক্যানভাসে হাজির হয় লাল-নীল-সবুজ-গেরুয়া নানা রং। বলা যায়, একেক দলই যেন প্রকারান্তরে উঠে আসে একেক দেওয়ালে। দেওয়াল লিখনের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বাংলায়। কিন্তু এখন যেন ভোটের লিখনে অনেকটাই ভাটার টান।
দেওয়াল জুড়ে পথে নামার ডাক। ‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা’। সলিল চৌধুরীর সেই বিখ্যাত গণসংগীত, একসময় যা বামেদের মুখে মুখে ফিরত, গেরুয়া শিবিরের দেওয়াল লিখনে ঠাঁই করে নিয়েছে সেই পঙক্তি। আবার ঘাসফুলের দেওয়াল লিখনে চোখে পড়ছে শঙ্খ ঘোষ বা শ্রীজাত-র এমন পঙক্তিও, যা আসলে লেখা হয়েছিল রাজ্যের শাসক দলের কোনও কাজের বিরোধিতাতেই। প্রচারের তোড়ে বক্তব্য আর আদর্শের অভিমুখ এমন গুলিয়ে যাওয়া দেখে ওয়াকিবহাল মহলের প্রশ্ন, ভাঙা দেওয়ালের মতো দেওয়াল লিখনের নেপথ্য ভাবনাচিন্তাতেও কি তবে ফাটল ধরেছে? শুধু তো এটুকুই নয়, কবিতা-গানের বদলে যেখানে নিজস্ব স্লোগান, মন্তব্য দেখা যাচ্ছে, সেখানেও এই প্রশ্ন উঠে আসতে বাধ্য। যেমন ধরা যাক, কোনও একটি দল দেওয়ালে লিখেছে, ‘বয়ফ্রেন্ড সরকারি চাকরি পাচ্ছে না? তাহলে বয়ফ্রেন্ড নয়, সরকার বদলান’। বোঝাই যাচ্ছে, কোনও না কোনও বিরোধী দলেরই লেখা এ কথা। তবে চব্বিশের নির্বাচনের প্রাক্কালেও চাকরির দাবিটি কেবল পুরুষের জন্যই বরাদ্দ থাকবে, এহেন ভাবনা অবাক করে। সময় এগোল, বাইরের দুনিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ল, এমনকি রাজনৈতিক পরিসরেও ক্রমশ জায়গা করে নিলেন অনেক নারীই, তারপরেও নারীকে নিয়ে রাজনৈতিক ভাবনার পরিণতি এল কোথায়! মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হওয়ার পরেও যেভাবে বিরোধী দলের মহিলা প্রার্থীর দিকে বেফাঁস কটাক্ষ ছুড়তে দ্বিধা করছেন না কোনও কোনও নেতা, সেই প্রবণতাই তো ফুটে উঠছে এহেন দেওয়াল লিখনে। সব মিলিয়ে, দেওয়াল জোড়া প্রচার আছে বটে, কিন্তু আগের সময়ের তুলনায় এখন লিখনের জোর কতটা বজায় আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক মহলেই।
আরও শুনুন:
ভোটের বাজার হাজারও দুর্নীতির অভিযোগে সরগরম, আদৌ কি তাতে প্রভাবিত হন ভোটাররা?
বরাবরই, নির্বাচন এসে হাজির হলেই হঠাৎ রঙিন হয়ে ওঠে চারপাশ। নতুন পুরনো ভাঙাচোরা সব দেওয়ালে নতুন করে লাগে সাদা রঙের পোঁচ। আর সেই সাদা রঙের ক্যানভাসে হাজির হয় লাল-নীল-সবুজ-গেরুয়া নানা রং। বলা যায়, একেক দলই যেন প্রকারান্তরে উঠে আসে একেক দেওয়ালে। রাজনীতির ময়দানে যতই লড়াই থাক না কেন, পাশাপাশি দেওয়ালে, কিংবা কখনও এক দেওয়ালেই পাশাপাশি সহাবস্থান করে বসেন শাসক-বিরোধীরা। এই দেওয়াল লিখনের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বাংলায়। নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময়ই হোক কিংবা তেভাগার সময়, বারবারই দেওয়ালে দেওয়ালে ফুটে উঠেছে মানুষের দাবি। অভিনব কার্টুন কিংবা ছড়া-কবিতা-গানের মধ্যে দিয়ে তা আরও জোর পেয়েছে। দেওয়ালচিত্রে মেহনতি মানুষের কথা তুলে ধরেছেন চিত্তপ্রসাদ কিংবা জয়নুল আবেদিন। সব মিলিয়ে শিল্প আর সুস্থ মননকে ছুঁয়ে থেকেই প্রতিবাদের বয়ান লিখেছিল বাংলা। সংসদীয় ভোটযুদ্ধের সময়ও তার প্রভাব পুরোপুরি মুছে যায়নি। পুরনো মানুষেরা বলেন, ভোটের ময়দানে যতই লড়াই থাক, ভোটের আগে দেওয়াল লিখনে যে কথার লড়াই চলত, তাতে কুৎসার চাষ ছিল না তেমন। দেখা যেত, এক পাড়ায় কোনও দল প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে ছড়া লিখলে অন্য পাড়ায় দিন কয়েকের মধ্যে জবাবি ছড়া লিখে ফেলত তাদের বিরোধী দল। শালীনতার মধ্যে থেকে সমান তালে আঁকা হত বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের কার্টুনও। কবির লড়াইয়ের মতোই সেইসব রাজনৈতিক শ্লেষ পাল্লা দিত একে অপরের সঙ্গে, যা আমজনতাকেও একরকম সুস্থ বিনোদনের জোগান দিত। কিন্তু বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে ভোটের লিখনে অনেকটাই যেন ভাটার টান, এ কথা মানছে রাজনৈতিক মহলও। ভোটের ছড়া, বা গরম গরম স্লোগান দেওয়ালে লেখা হচ্ছে বটে, কিন্তু মানে ও গুণে তাকে আগের চেয়ে বেশ কমজোরি বলেই মনে করছেন তাঁরা। সিঙ্গুরের পর টাটা ন্যানো ইস্যুতে, চিটফান্ড ইস্যুতে, ‘খেলা হবে’-র জনপ্রিয় স্লোগানে কিছু কিছু রাজনৈতিক ছড়া দেওয়াল লিখনে দেখা গিয়েছে বটে। তবে অনেকসময়ই কটাক্ষ ছাপিয়ে উঠছে কুৎসা আর ব্যক্তি-আক্রমণ, তাও কোনও শৈল্পিক আড়াল না রেখেই। কাদা ছোড়াছুড়িতেই ভরে উঠছে দেওয়াল লিখন। বছর কয়েক আগে সেখানে একটা পালটা লিখনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন বাম দলের দুই শিল্পী। ফেসবুকের দেওয়াল হোক কি বাস্তবে, কেবল জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে যে নিরাবরণ কুৎসাকে হাতিয়ার করছে ভোটপ্রচার, তার জবাবে ফ্রেস্কোর ধাঁচে না-পাওয়া মানুষের অধিকারের কথা বলেছিলেন তাঁরা। তবে সে তো সাময়িক, সংক্ষিপ্তও। গোটা বাংলার দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে, দেওয়াল লিখনে বৈচিত্র্য কমে গিয়েছে অনেকটাই।
আরও শুনুন:
প্রথমবার আঙুলে কালি, ভোটের খেলা ঘুরিয়ে দিতে ওস্তাদ নতুন ভোটাররাও
আসলে সোশাল মিডিয়ার দেওয়ালে যে আক্রমণ পালটা আক্রমণকে ক্রমশ আত্মস্থ করে নিয়েছে মানুষ, বাস্তবের দেওয়াল সেই চোট এড়াবে কী করে! আম মানুষের মনের দেওয়ালগুলোই যে ক্রমশ একরঙা হয়ে উঠছে। পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণুতার রং তুলি বুলিয়ে দিচ্ছে সেইসব দেওয়াল জুড়ে। আর তারই ছাপ ফুটে উঠছে হাল আমলের দেওয়াল লিখনেই। দেওয়াল জোড়া প্রচার আছে বটে, কিন্তু লিখনের চারিত্র্যে যে ‘পরিবর্তন’ এসে গিয়েছে, তাকে আর বদলাবে কে!