আধুনিকতার ধারণার এমন এক বিজ্ঞাপন সাধারণ ভাবে তুলে ধরা যায়, যা প্রায় প্রকৃতিবিযুক্ত। অথচ মানুষের জীবন এমন ছিল না। নগর আর গ্রামের জীবন নিশ্চিতই এক রকম নয়। কিন্তু প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে বাঁচার কথা মানুষ ভাবেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ধারণার ভিতর ঢুকেছে বেনোজল। দূষণের প্রতিরোধে প্রত্যেকেরই ভূমিকা থাকে। তা কীভাবে পালন করা সম্ভব? দম্পতির এই যাপন যেন তারই মডেল উত্তর।
দূষণের দিল্লিতে এ-বাড়ি যেন এক সবুজদ্বীপ। আদতে এক দম্পতির সংসার। তবে সেখানে শুধু মানুষের আনাগোনা নেই। তা যেন গাছেদেরও সংসার। সুবজের সোহাগ ছড়িয়ে আছে বাড়ির সর্বত্র। আর তাতেই ম্যাজিক। যেখানে দিল্লির বাতাস দূষণে আচ্ছন্ন, শ্বাসরোধী হয়ে পড়ছে ক্রমশ, সেখানে এই বাড়ি যেন ‘মুক্তাঞ্চল’। সামগ্রিক রাজধানীর এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স যেখানে ৩০০, সেখানে এ-বাড়ির ক্ষেত্রে সূচক মোটে ১৫। দূষণের মোকাবিলায় দম্পতির গেরস্থালী তাই যেন হয়ে উঠেছে উদাহরণ।
পিটার সিং আর নিনো কাউরের যাপন কেন হয়ে উঠেছে উদাহরণ? শুধু দিল্লির দূষণের মাঝে তাঁরা যে একটি নমুনা তৈরি করেছেন, তাই-ই নয়। বলা যায়, যেভাবে মানুষেরই তৈরি দূষণ মানুষের বেঁচে থাকার পথে অন্তরায় হয়ে উঠছে, সেখানে অন্য যাপনের ছবি তুলে ধরেছেন তাঁরা। বাড়ি তৈরির সময়ই বিষয়টি তাঁদের মাথায় ছিল। বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের চিরায়ত যে সব পদ্ধতি, আধুনিক সভ্যতা সেসব অনেকাংশে বাতিল করেছে। তার একটি কারণ, খরচ কমানো। কিন্তু তাতে বেঁচে থাকাই যে অসহ হয়ে উঠবে, প্রাথমিক ভাবে তা অনেকেরই মাথায় থাকে না। এই দম্পতি প্রথমেই সে কথা ভেবেছিলেন। সিমেন্টের বদলে তাই চুনসুরকির ব্যবহার করা হয়েছে একেবারে গাঁথুনির সময়। ছাদেও কংক্রিটের বদলে পাথরের স্ল্যাব ব্যবহার করা হয়েছে।
আরও শুনুন: অনলাইনে কেনাকাটা সারবেন, এদিকে এল না ওটিপি! জালিয়াতি রুখতে নয়া সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের
এরপর আসে গাছ লাগানোর পালা। গোটা বাড়িটি তৈরিই করা হয়েছে এরকম ভাবে, যাতে বহুসংখ্যক গাছ সেখানে থাকতে পারে। এখন হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, প্রায় হাজার পনেরো নানারকমের উদ্ভিদ যেন এই ঘরের পাহারাদার। দূষণ শুষে তারা, দুই সহনাগরিককে দিচ্ছে শ্বাস নেওয়ার বিশুদ্ধ বাতাস। তা, এত সংখ্যক গাছের লালন-পালন তো চাট্টিখানি কথা নয়। দরকার পর্যাপ্ত পরিবারে জল। আর তার জন্য বাড়িতে আছে অতিকায় ট্যাঙ্ক, যা কিনা বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে রাখে, প্রায় ১৫০০০ লিটার জল। সেই জল পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থাও করেছেন তাঁরা, যাতে জল নষ্ট না হয়। এমনকী সবজির জন্যও কেনাকাটার ভরসায় না থেকে তাঁরা নিজেরাই চাষ করে নেন। এসবেরই সুফল মিলেছে। গরমের প্রকোপ কমেছে। একই সঙ্গে দূষণের মাত্রা নেমে গিয়েছে। প্রায় মডেল হয়ে উঠেছে এই বাড়ি।
দিল্লির দূষণের প্রেক্ষিতে দম্পতির এই প্রয়াস যে আলাদা মাত্রা পেয়েছে, তা বলতেই হবে। তবে, সেই গুরুত্ব ছাপিয়েও তাঁদের এই যাপনের আরও বৃহত্তর ভূমিকা আছে। প্রকৃতির উপর মানুষের অনাবশ্যক খবরদারি দিনে দিনে মানুষের অস্তিত্বকেই বিপন্ন অরে তুলেছে। তাতে ইন্ধন জুগিয়ে চলে পুঁজিচালিত সভ্যতা। আধুনিকতার ধারণার এমন এক বিজ্ঞাপন সাধারণ ভাবে তুলে ধরা যায়, যা প্রায় প্রকৃতিবিযুক্ত। অথচ মানুষের জীবন এমন ছিল না। নগর আর গ্রামের জীবন নিশ্চিতই এক রকম নয়। কিন্তু প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে বাঁচার কথা মানুষ ভাবেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ধারণার ভিতর ঢুকেছে বেনোজল। প্রকৃতিকে জয় করার মানসিকতা মাথাচাড়া দিয়ে মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে। আর সেই তথাকথিত আধুনিকতাই ডেকে এনেছে সভ্যতার সংকট। মানুষ তো প্রকৃতির বাইরে নয়। বরং প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য পাতিয়েই তার দীর্ঘ যাপন। যাপনচিত্রের বদলেই আজ মানুষের ওষ্ঠাগত প্রাণ। দূষণ নিয়ে সভা-সেমিনার হয়, কাজের কাজ কতটুকু হয়, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
এই সবকিছুর মধ্যেই পালটা বাঁচার নমুনা হয়ে উঠেছে দম্পতির এই ‘সবুজ বাড়ি’। গোয়া থেকে যখন তাঁরা দিল্লিতে এসেছিলেন, তখনই এই ভাবনা তাঁদের মনে ছিল। এবং তাঁরা তা বাস্তবায়িত করেছেন। শহরের মধ্যেও যে এরকম ভাবে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা বজায় রাখা যায় তা হাতেকলমেই করে দেখিয়েছে। দূষণের প্রতিরোধে প্রত্যেকেরই ভূমিকা থাকে। তা কীভাবে পালন করা সম্ভব? দম্পতির এই যাপন যেন তারই মডেল উত্তর। নিজেদের স্বার্থেই আমরা তা অনুসরণ করতে পারি, তাতে লাভ বই ক্ষতি নেই।