প্রত্যেক বছর কেবল মৃতদেহের সদ্গতি করার উদ্দেশ্যে কফিন বানাবার জন্য কত গাছ কাটা পড়ে জানেন? পরিবেশের মুমূর্ষু অবস্থা নিয়ে যাঁরা চিন্তিত, এত সবুজ ধ্বংস নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই উদবিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। তাই এর বিকল্প উপায়ও খুঁজে বের করেছেন তাঁদের একজন। কী সেই উপায়? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
মানুষ যে মরণশীল, এ তো আর নতুন কথা নয়। কোনও ধর্মমতে দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়, কোথাও কবর দেওয়া হয়, কোথাও আবার তার গতি হয় টাওয়ার অফ সাইলেন্সে। মৃত্যুর পর তার দেহ ফিরে যায় প্রকৃতিতেই। কিন্তু এই সবকিছুর ফলেই প্রকৃতির জন্যও কিছু ক্ষতি বরাদ্দ হয়। এমনকি কবর দেওয়া, যেখানে পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনা নেই, সেখানেও কফিন বানাবার জন্য কাটা পড়ে একাধিক গাছ। ইউরোপ, আমেরিকা দুই মহাদেশ ছাড়াও সারা পৃথিবীর খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষদের অন্তিম সৎকারের জন্য একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। ফলে শুধুমাত্র কফিনের চাহিদা মেটাতেই প্রতি বছর কাটা পড়ে লক্ষ লক্ষ গাছ। আবার কফিনবন্দি মৃতদেহের বিয়োজন হতে সময় লাগে প্রায় ২০ বছর। ততদিনে কফিনের কাঠও আংশিকভাবে মিশে যায় মাটির সঙ্গে। ফলে, পুনর্ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। এদিকে গোটা বিশ্ব জুড়েই সবুজ কমে আসার ফলে দূষণ এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের সঙ্গে মোকাবিলা করার পথ যে ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে, সে কথাও জানা। এই পরিস্থিতিতে প্রচুর পরিমাণ কাঠ এইভাবে মাত্র একবার ব্যবহার করার জন্য বরাদ্দ করার সুযোগ আর সত্যিই নেই। তাই এমন এক উপায় খুঁজে বের করেছেন নেদারল্যান্ডের মানুষ বব হেনড্রিক্স, যেখানে এই ধর্মীয় রীতিও বজায় রাখা সম্ভব, আবার গাছ বাঁচানোও সম্ভব।
আরও শুনুন: ‘দয়া করে এদিকে আসবেন না’… ২৬/১১-র মুম্বাই হামলায় শতাধিক মানুষের প্রাণ বাঁচায় এ ঘোষণা
কী সেই উপায়? এমন এক পরিবেশবান্ধব কফিন তৈরি করে ফেলেছেন হেনড্রিক্স, যা বানাতে কাঠের প্রয়োজনই পড়বে না। এমনিতে আকৃতি প্রকৃতিতে এই জৈব কফিনের সঙ্গে চলতি কফিনের কোনও পার্থক্য নেই। যা কিছু পার্থক্য, তা এর উপাদানে। কার্ডবোর্ড, বাঁশ, কলাপাতা, নলখাগড়ার মতো বিভিন্ন জৈব পদার্থ দিয়ে তৈরি এই কফিন সহজেই মিশে যেতে পারে মাটির সঙ্গে। তা ছাড়া এই কফিনে বিশেষ প্রকার ছত্রাক ও জৈব সার থাকার ফলে ছ’সপ্তাহের মধ্যেই মৃতদেহটি সম্পূর্ণভাবে বিয়োজিত হয়। মৃতদেহ বিয়োজনের জন্য কোনোরকম রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করারও প্রয়োজন হয় না, ফলে মাটির ক্ষতি হয় না। আবার সাধারণ কাঠের কফিন হোক কিংবা সুন্দর কারুকার্য করা ভারী কাঠের কফিন, পরিবেশে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে, জৈব কফিনের কার্বন নির্গমনের হার তার চেয়ে অনেকটাই কম। কারণ ওই ছত্রাক। দেহের বিয়োজনে তৈরি কার্বন পরিবেশে মেশার আগেই শোষণ করে নেয় মাইসেলিয়াম প্রজাতির ওই ছত্রাক। বোঝাই যাচ্ছে, বব হেনড্রিক্সের তৈরি এই জৈব কফিন মৃতদেহ সৎকারের ফলে হওয়া পরিবেশ দূষণের হার অনেকটাই কমিয়ে দিতে সক্ষম। পাশাপাশি আরেকটি অভিনব মানবিক ছোঁয়া যোগ করেছেন তিনি। এই কফিনের মধ্যেই তিনি রেখে দেন গাছের বীজ। জৈব সার পেয়ে ওই বীজ থেকেই বেড়ে ওঠে গাছ।
আরও শুনুন: বিশ্ব উষ্ণায়নে উষ্ণতা হারাচ্ছে সম্পর্ক, ডিভোর্সের পথে হাঁটছে সামুদ্রিক আলবাট্রস-রাও
জয় গোস্বামী লিখেছিলেন, “নাম লিখেছি একটি তৃণে/ আমার মায়ের মৃত্যুদিনে”। যে প্রিয় মানুষটি রইলেন না আর, সবুজের মধ্যে দিয়ে চিরন্তন হয়ে যেতে পারেন তিনিও। একই কথা বলা চলে বব হেনড্রিক্সের এই জৈব কফিন সম্বন্ধেও। প্রিয়জনের স্মৃতি বুকে নিয়ে বেড়ে উঠবে এক বা একাধিক গাছ, বেঁচে থাকবে বছরের পর বছর, এর চেয়ে আকাঙ্ক্ষিত তর্পণ আর কীই বা হতে পারে!