রামচন্দ্র দাস আর খায়রুল ইসলাম খান।পাশাপাশি। নির্দ্বিধায়। নিসংকোচে। যেমন পাশাপাশি তাঁদের দোকান লোকনাথ বাদ্য ভাণ্ডার আর খান ব্যাগ এন্টারপ্রাইজ। এক ঠোঙায় মুড়ি খান দু’জনে। আপদে বিপদে আগলান, একে অন্যকে। রামমন্দির নিয়ে ক্ষোভ নেই খায়রুলের। ইদ, দুর্গাপুজোয় একসঙ্গেই থাকেন রামচন্দ্র। দ্বেষের আবর্তে পড়া দেশে তাঁরা যেন একচিলতে পুরনো ভারতবর্ষ আর এই বাংলার ভালোবাসার বারান্দা।
দেখে এলেন, শুভদীপ রায়।
‘রাম, দোকানটা খোলা রইল, দেখিস।’ – বলে নিশ্চিন্তে কাজে বেরিয়ে পড়তে পারেন খায়রুল ইসলাম খান। আবার মুড়ি খাওয়ার সময় নিজের ঠোঙা রামের দিকে এগিয়ে দিতে একটা দিনও ভোলেন না খায়রুল। দুজনে এক ঠোঙা থেকেই মুড়ি খান। সংসারের গল্পগুজব করেন। প্রায় দু-দশক পাশাপাশি থাকা। একই রোদ, একই বৃষ্টি, একই রকম লাভ-লোকসানে দিন গুজরান। ধর্ম অবশ্য আলাদা। তবে তাতে কী! আজও হাতে হাত রাখতে কোনও সমস্যা নেই রামচন্দ্র আর খায়রুলের।
ডায়মন্ড হারবার মেন রোড ধরে এগোলে, পুরসভার কাছাকাছি গিয়ে চোখে পড়বে পাশাপাশি দুটো দোকান– লোকনাথ বাদ্য ভাণ্ডার আর খান ব্যাগ এন্টারপ্রাইজ। নামেই মালুম, দুই দোকানের মালিক দুই ধর্মের। একেবারে গায় গা লাগানো দোকান। খুব বড়সড় নয়। পাড়ার মধ্যে ছোট ছোট দুই ঘর বসতি যেমন ঘা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে, ঠিক সেরকমই। বাদ্য ভাণ্ডারে সাজানো শ্রীখোল, তবলা, নাল। আর একদিকের দেওয়াল আলো করে আছেন প্রায় সব দেবদেবী। সবার উপরে বাবা লোকনাথ। ব্যাগ সেন্টারে প্রত্যাশামতোই কোনও ছবি নেই। নানা রঙের ব্যাগের সম্ভার সাজানো এদিক ওদিক। আর দুই দোকান আগলে বসে আছেন– খায়রুল আর রামচন্দ্র। পাশাপাশি। নির্দ্বিধায়। নিসংকোচে।
এমনটাই তো স্বাভাবিক। যতটা স্বাভাবিক এঁরা দুজন। তবু গত এক দশকে এই দেশ যেরকম দ্বেষের আবর্তে পড়েছে, তাতে স্বাভাবিক দৃশ্যেও যেন খটকা লাগায়। ভোটের হাওয়া এখন দেশ জুড়ে, বাংলাতেও। সেই হাওয়ার গায়ে গুঁড়ো গুঁড়ো মিশে আছে সাম্প্রদায়িকতাও। একেবারে অস্বীকার করতে পারছেন না কেউ-ই। নেতারা পরস্পরের বিরুদ্ধে বয়ান দিচ্ছেন। একে অন্যের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন। সেই তুলে ধরা তর্জনীর নিচে তিরতির করে বয়ে যাছে হাতে-হাত-রাখা সম্প্রীতির বাংলা। দোকান দুটোর বয়স অনেকটাই। মালিকানাতেও রদবদল হয়েছে। এখন যাঁদের দায়িত্ব দোকান সামলানোর, তাঁরাই হলেন রামচন্দ্র এবং খায়রুল। সারাদিন তো একসঙ্গেই থাকেন। রাজনীতির কথাবার্তা কি আর হয় না! সারাক্ষণ কি আর মুখে আঙুল দিয়ে থাকা যায়? তাঁদের অবশ্য সে প্রয়োজনও পড়েন। দীর্ঘদিনের সহাবস্থানে তাঁরা জানেন, ধর্মপরিচয় নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ; তবে তাই-ই একমাত্র পরিচয় নয়। সবার আগে তাঁরা দু’জন মানুষ, দুই বন্ধু। অতএব বন্ধুতে বন্ধুতে যা হয়! একসঙ্গে থাকতে দু’জনে একে অপরকে পরিবারের মানুষ হিসাবেই এখন ভাবেন তাঁরা। যার বাড়িতেই ভালো খাবার হোক, সঙ্গে করে নিয়ে আসতে ভোলেন না। তবু, চারিদিকে তো হিংসার খবরের ছড়াছড়ি। সেইসব খবর পেলে মনটা কি হু-হু করে ওঠে? খায়রুল বলছেন, ‘খুবই কষ্ট হয়। আমরা যে ভারতবাসী, সেই কথাটাই যেন অনেকে ভুলে গেছে। বিবেকানন্দের উক্তি আমরা মনে রাখিনি।’ খায়রুলের গলায় খানিকটা আক্ষেপ। তবে যা-ই হোক না কেন, তাঁদের মনের বাঁধন আলগা হয় না। রামচন্দ্র বলছেন, ‘আমরা মিলেমিশেই থাকি। পুজো, ইদ যা-ই হোক, একসঙ্গে থাকি, একসঙ্গে খাই। সুবিধা-অসুবিধায় একে অন্যকে দেখি। আমাদের মধ্যে কোনও হিংসা, বিভেদ নেই।’ এদিকে রাজনীতির হাওয়া তো থেকে থেকেই মন্দির-মসজিদ ইস্যুতে সরগরম হয়ে ওঠে। পাশাপাশি বসে থাকতে তখন অস্বস্তি হয় না? প্রশ্ন শুনে রামচন্দ্রের হয়েই যেন খায়রুল জবাবটা দিয়ে দিলেন, “রামমন্দির তৈরির বিরুদ্ধে আমার ক্ষোভ থাকবে কেন? সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, সুতরাং তার বিরুদ্ধে বলা কিছু উচিত হবে না।’ একটু থেমে আর একটু যোগ করলেন, ‘আমার কী মনে হয় জানেন, প্রত্যেকের ধর্ম তার কাছে বড় আর পবিত্র। আমি তো মনে করি, এক ধর্মের মানুষের, অন্যের ধর্মকে শ্রদ্ধা জানানোই উচিত।’
তবু সম্প্রদায়গত বিভেদের চোরাটান তো সর্বত্রই। তাঁরাও নিশ্চিত তা টের পান। দেশটার ভিতর থেকে একটা বদল এসেছে। নানা ঘটনা তার সাক্ষ্য দিয়ে যায়। রাজনীতিও থেকে থেকে সেই বিভাজনে প্রশ্রয় দেয় ফায়দা লুটতে। আর কষ্ট-যন্ত্রণার পোড়া ছাই গায়ে মেখে নেন সাধারণ মানুষ। তবু যেন প্রতিজ্ঞা টলে যায়। ইতিহাস তখন নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে প্রহসন হয়ে। অতএব বিদ্বেষের বাষ্পে যে ইদানীং হাঁফ ধরে দেশের, তা একেবারে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সে কথা ধরিয়ে দিতে, রামচন্দ্র আর খায়রুল একযোগে বলে ফেলেন– ‘বিশ্বাস করুন, এই চাপ থাকবে না, কেটে যাবে।’ তাঁদের সেই একান্ত বিশ্বাসের সামনে তখন যেন মাথা নুইয়ে ফেলে যাবতীয় বিদ্বেষ। অস্বস্তির যাবতীয় প্রশ্ন পেরিয়ে তাঁরাও আবার ডুবে যান আত্মীয়তায়। এই দেশের শিরা-উপশিরায় যে বিভেদ-অসুখ ছড়িয়ে গিয়েছে বলে অনেকের আক্ষেপ, সেই অসুখের ভিতর যেন তখন শুশ্রূষা হয়ে ওঠেন তাঁরা-ই। সময় চলে যায়। রাজনীতি গড়িয়ে যায়। তবু খায়রুল আর রামচন্দ্রের হাতেই জেগে থাকে একচিলতে পুরনো ভারতবর্ষ আর এই বাংলার ভালোবাসার বারান্দা।