সব আন্দোলন হয়তো প্রত্যাশিত ফলাফল বয়ে আনতে পারে না। তবে এক একটি আন্দোলন যে গণজাগরণের জন্ম দেয় তার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। সম্মিলিত প্রতিবাদে আজও ন্যায় মেলে। অধিকার সুনিশিচিত হয়। মানুষের এই মিলিত শক্তিকে ভাঙার চেষ্টা কম হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে। তবে মানুষের এই মিলিত শক্তিই যে শেষ পর্যন্ত সমাজকে আলোর পথ দেখায়, তা হয়তো বলাই যায়।
পথে নামলেই পথ চেনা। তবে, পথের শেষ কি সব সময় মেলে? মেলে কি গন্তব্য? এই সব প্রশ্ন অমূলক নয়। নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন সাধারণ মানুষ গণতান্ত্রিক ভাবে পথে নামেন, তাঁরা প্রত্যাশা করেন সুবিচার মিলবে। সেই অন্যায়ের প্রতিকার হবে। এ কথা ঠিক, সব সময় সে আশা পূরণ হয় না। তবু হাল ছাড়লে কি চলে? প্যারিসের সাম্প্রতিক প্রতিবাদ যেন সেই আশার সলতেটাই আর একটু উসকে দিল।
আমার বিচার চাই- এই স্লোগানকে পাথেয় করেই পথে নেমেছিলেন হাজার হাজার মানুষ। বিশেষত মহিলারা। জিসেল পেলিকোর উপর যে ভয়াবহ ও ধারাবাহিক নির্যাতন চলেছিল, তার প্রতিবাদেই ফুঁসে উঠেছিল ফ্রান্স। প্যারিসের রাজপথ ভেসে গিয়েছিল আন্দোলনে। সাহস বোধহয় দিয়েছিলেন ওই মহিলাই। বয়স সত্তরের উপর। আর এই বয়সে এসেও তিনি তাঁর উপর হওয়া নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। সাফ জানিয়েছিলেন, তাঁর স্বামীই দোষী। স্বামীই ক্রমাগত নির্যাতন চালিয়েছেন তাঁর উপর। একা নয়, দিনের পর দিন অন্যদের ডেকে এনে তাঁর উপর চালিয়েছে নির্যাতন। নির্যাতনকারীর সংখ্যা ৫০ জনেরও বেশি। ঘটনার ভয়াবহতায় কেঁপে উঠেছিল সহনাগরিকের অন্তরাত্মা। এমনটাও সম্ভব! জিসেল নিজেই বিস্ময় প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, এমন একজনের সঙ্গে তিনি যে এতদিন বাস করেছেন, তা ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছেন নিজেই। আর সেই ঘটনা যত শুনছিলেন তত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিলেন প্যারিসবাসী। ফুঁসে উঠছিলেন প্রতিবাদে। রাজপথ তার সাক্ষী ছিল। এমনকী পোশাক খুলেও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মহিলারা। সত্তর পেরিয়ে যাওয়া গিসেল নির্যাতন নিয়ে সোচ্চার হয়ে যেন ভেঙে দিয়েছিলেন সকল অচলায়তন।
মাসখানেক পরে ফ্রান্সের আদালত এই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করেছে মোট ৫১ জনকে। মাদক সেবন করিয়ে ধর্ষণ করার অপরাধে অভিযুক্ত ছিল যারা, তারা কেউ ছাড় পায়নি। সেই তালিকায় আছে জিসেলের প্রাক্তন স্বামী দমিনিক পেলিকট-ও, ২০ বছরের কারাদণ্ডের সাজা ধার্য হয়েছে তার জন্য। অন্যদের অপরাধের নিরিখে ৪ থেকে ১৮ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ আদালতের।
প্যারিসের এই ঘটনা যেন আশার আলো দেখাচ্ছে গোটা বিশ্বকেই। এ বিশ্বে কোথায় নারী সুরক্ষিত? এ প্রশ্নের উত্তর নেই। গোটা বিশ্ব যেমন ক্রমে ক্রমে ফ্যাসিস্ট শক্তির কবজায় চলে যাচ্ছে, তেমনই বাড়ছে নারীর উপর নির্যাতনের ঘটনা। কখনও বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা হতোদ্যম করছে আন্দোলনকারীদের। তাহলে কি সুবিচার আদায়ের কোনও পথই খোলা নেই? প্যারিস জানাল, পথে নামাই হচ্ছে সেই পথ। সব আন্দোলন হয়তো প্রত্যাশিত ফলাফল বয়ে আনতে পারে না। তবে এক একটি আন্দোলন যে গণজাগরণের জন্ম দেয় তার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। সম্মিলিত প্রতিবাদে আজও ন্যায় মেলে। অধিকার সুনিশিচিত হয়। মানুষের এই মিলিত শক্তিকে ভাঙার চেষ্টা কম হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে। তবে মানুষের এই মিলিত শক্তিই যে শেষ পর্যন্ত সমাজকে আলোর পথ দেখায়, তা হয়তো বলাই যায়। আর সেটিই মানুষে এক ও একমাত্র শক্তি। অন্তত প্যারিসের আন্দোলন এবং সুবিচার যেন মানুষের মিলিত শক্তির উপর আশা-ভরসার সেই আলোটুকুকেই জ্বালিয়ে রাখল।