আমিষ টিফিন আনার অভিযোগে উত্তরপ্রদেশের এক স্কুল থেকে বরখাস্ত হয়েছিল তিন পড়ুয়া। মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষের সেই ঘটনায় তাজ্জব হয়েছিল গোটা দেশ। লড়াই শুরু করেছিলেন তিন সন্তানের মা। শেষ পর্যন্ত দেশের আইন-আদালত সহায় হল তাঁর।
‘এরাই বড় হয়ে মন্দির ভাঙবে’- একরত্তি বাচ্চার সম্পর্কে স্কুলের প্রিন্সিপালের এই মন্তব্যে তাজ্জব হয়েছি গোটা দেশ। অভিযোগ ছিল, বাচ্চাটিকে স্কুলে আমিষ টিফিন দেওয়া হয়েছে। আর সেই টিফিন খাইয়ে সে নাকি অন্য বাচ্চাদের ধর্মান্তরণে মদত দিচ্ছে। এই ইস্যুতেই বাচ্চাটির মায়ের সঙ্গে তুমুল বাকবিতণ্ডা চলেছিল। আর সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল নেটদুনিয়ায়। প্রশ্ন উঠেছিল, এই দেশে সংখ্যালঘুদের পড়াশোনার অধিকার ভবিষ্যতে রক্ষিত হবে তো? সেই প্রশ্নের উত্তর মিলল। আর তা মিলল একজন মায়ের লড়াইয়ের দরুন।
সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিক। চর্চায় উঠে এসেছিল উত্তরপ্রদেশের স্কুলের এই ঘটনাটি। ঘটনার কেন্দ্রে একটি বাচ্চা। স্কুলে মা তাকে টিফিন দিয়েছিল। আর সেই টিফিন বাক্স খুলতেই তুলকালাম বাধে। স্কুলের তরফে অভিযোগ ওঠে যে, বাচ্চাটি আমিষ টিফিন এনে ক্লাসের বাকি বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে। আর তাতেই আঘাত নেমে আসছে অন্য বাচ্চাদের ধর্মে। বাচ্চাটির মা সাব্রা খান আচমকাই স্কুলের তরফে একটি ফোন পান। জানতে পারেন, তাঁর সাত বছরের বাচ্চাটিকে ক্লাস করতে দেওয়া হচ্ছে না। আরও জানতে পারেন, স্কুলের কমপিউটর ল্যাবে তাকে ঘণ্টা পাঁচেক আটক করে রাখা হয়েছে। ওই স্কুলে তাঁর আরও দুই সন্তান পড়াশোনা করে। তড়িঘড়ি স্কুলে গিয়ে তিনি সন্তানকে উদ্ধার করেন। পুরো ঘটনাটি জানতে পারেন।
সাব্রার বক্তব্য, আমিষ টিফিন মোটেও দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছিল সোয়া-বিরিয়ানি। পরদিন স্কুলে গিয়ে তিনি প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করেন। এই কথা জানান। তবে তাতে পরিস্থিতি তো ঠিক হয়ইনি, উলটে আরও বিগড়ে যায়। সেই কথোপকথনের ভিডিও-তেই দেখা যায়, প্রিন্সিপাল সরাসরি মুসলিম সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে বিদ্বেষমূলক কথা বলছেন। তাতে তাজ্জব হয় গোটা দেশ। যে কথা প্রিন্সিপাল বলছেন, একটি সাত বছরের বাচ্চার তা বোঝার কোনও উপায়ই নেই। এমনকী তার মায়ের প্রতিবাদও সেখানে গ্রাহ্য হচ্ছে না। উলটে, সাব্রার তিন সন্তানকেই স্কুল থেকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এখান থেকেই শুরু সাব্রার লড়াই। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে তিনি শিক্ষাদপ্তরের দ্বারস্থ হন। তাতে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় বটে। তবে, শেষমেশ ক্লনিচিট পেয়ে যান ওই প্রিন্সিপাল। বরং ভাইরাল ভিডিওটি যে কারসাজি করে বানানো এমন অভিযোগ ওঠে। আরও জানানো হয় যে, সাব্রার সন্তানদের স্কুল থেকে বরখাস্ত করা হয়নি। এপ্রিল মাস থেকে তাঁদের স্কুলের মাইনে জমা পড়েনি, আর তাই সেপ্টেম্বর মাসে গিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ এই পদক্ষেপ করেছে। যদিও রিপোর্ট জানিয়েছিল, প্রিন্সিপাল যা বলেছেন, তা বলা উচিত হয়নি। তবু এই রিপোর্ট পেশের দরুন কার্যত হার হয় সাব্রার। তবু আশা ছাড়েননি তিনি। শুরু হয় তাঁর অন্য লড়াই।
এবার সরাসরি আদালতের দ্বারস্থ হন তিনি, দাখিল করেন পিটিশন। এলহাবাদ হাই কোর্টে তিনি, তাঁর তিন সন্তানের হয়ে লড়াই শুরু করেন। ডিসেম্বরে আদালত সবদিক খতিয়ে দেখে রায় দেয় যে, সাব্রার তিন সন্তানকেই কাছাকাছি অন্য স্কুলে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে জেলা প্রশাসনকে। তারা যাতে একই বোর্ডে পড়াশোনা করতে পারে তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ আমিষ টিফিন আনার কারণেই যে তিন জনকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তা আদালতের সিদ্ধান্তে স্পষ্ট। আর এই মুহূর্তটিকেই নৈতিক জয় হিসাবে দেখছেন সাব্রা ও তাঁর আইনজীবী। তাঁদের মতে, দেশের আইন যে আজও যে দেশবাসীর অধিকার সুনিশিচিত করে এই রায় তা প্রমাণ করে দিল। আর সেই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকল, সন্তানদের সম্মান ও সুরক্ষার জন্য একজন মায়ের লড়াই। সব লড়াই হয়তো সিনেমায় জায়গা পায় না, তবু কিছু কিছু বাস্তবের লড়াই যেন সিনেমার মতোই হয়ে ওঠে।