হিমালয়সংলগ্ন এলাকায় নানাভাবেই প্রকৃতি বিপন্ন। সোনম ওয়াংচুকের অনশনের জেরে সে খবর খুব সামান্য হলেও নাহয় সামনে এল। কিন্তু যা নিয়ে কথা বলছে না তেমন কেউ, সেই বাকি দেশ ভালো আছে তো?
সাড়ে ১১ হাজার ফুট উঁচুতে, এক বিন্দু খাবার ছাড়া দিনের পর দিন বসে ছিলেন একজন মানুষ। গলতে থাকা হিমালয়কে বাঁচাতে, পার্বত্য এলাকার বাস্তুতন্ত্র আর পরিবেশকে রক্ষা করতে টানা ২১ দিন ধরে অনশন চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। সেই দীর্ঘ লড়াইয়ে স্পটলাইটের উজ্জ্বলতা নেই, নেই দর্শকের হাততালিও। তবুও, পরিবেশভাবনার ছিটেফোঁটা না রেখে বিকাশের বুলডোজার চালালে যে আদতে আমাদের সকলেরই বিপদ, সে কথা বোঝাতেই অতন্দ্র প্রহরী হয়ে বসেছিলেন সোনম ওয়াংচুক। তাঁর এই লড়াইয়ের দিকে সরকার আদৌ ফিরেও তাকিয়েছে কি না, সে কথা এখনও বলা মুশকিল। তবুও, লড়াই তো জারি আছে। কিন্তু গোটা দেশ জুড়ে তো একাধিক সোনম ওয়াংচুক নেই। সেই বাকি দেশে পরিবেশ বেশ আছে তো?
-: আরও শুনুন :-
World Water Day: অবাক জলপান! জলের দরে আর মেলে না জল
সত্যি বলতে, যে এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয় গোটা দেশ, সেই লাদাখের পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুক ঠিক কী কারণে অনশনে বসেছিলেন, তা নিয়েও গোটা দেশ বিশেষ মাথা ঘামায়নি। সোনম যখন প্রশ্ন তুলছেন, “আমাদের পাহাড়গুলোকে বিভিন্ন শিল্প সংস্থা আর আর খনি সংস্থার কাছে বেচে দেওয়াটাই লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার আসল উদ্দেশ্য নয় তো?’’ তার উত্তরে মুখে কুলুপ এঁটে ছিল দেশ। সোনম জানিয়েছেন, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার পর কীভাবে পরিবেশের কথা না ভেবেই পুঁজি আর শিল্পের অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে লাদাখে। কীভাবে সেইসব বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের জেরে উৎখাত হতে হচ্ছে জনজাতির মানুষকেও। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই ছবি কি কেবল লাদাখের একার? বিগত কয়েক বছরে উত্তরাখণ্ড ও সংলগ্ন পার্বত্য এলাকায় বারবার ধস নেমেছে। সেই সময় পরিবেশবিদরা বারবারই সতর্ক করেছেন যে যথেচ্ছ উন্নয়ন বা শিল্পের বাড়াবাড়ি সেখানে বিপদ ডেকে আনবে। কিন্তু তারপরেও, সে কথাও কান দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি প্রশাসন। কিংবা সতর্কতা বাড়েনি আমাদের মধ্যেও।
-: আরও শুনুন :-
সিনেমায় তাঁকে এনেছিলেন আমির, পরিবেশ বাঁচাতে টানা অনশন সেই বাস্তবের র্যাঞ্চোর
এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট, মানে একটা বড়সড় উন্নয়নের কাজ করতে গেলেই পরিবেশের উপর তার ফলাফল বিচার করা-র যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা ইতিমধ্যেই নাকচ করেছে কেন্দ্র। এর মধ্যে এলাকার বাসিন্দাদের মতামত নেওয়ার বিষয়টিও ছিল। কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদিই জানিয়ে দিয়েছেন, কারখানা কিংবা রাস্তা বানানোর জন্য, নগরায়ণ বা শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনে জঙ্গল কাটতে হলে সেখানে বসবাসকারীদের অনুমতি নেওয়ার কোনও দরকার হবে না। তাঁদের কেবল কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়াই যথেষ্ট। অর্থাৎ, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘পরিবেশ সুরক্ষা’ বিষয়ে যেসব কাজকে ক্ষতিকারক ও বেআইনি করে রাখা হয়েছিল, গত কয়েক বছরে তার প্রত্যেকটিকে আইনি করে নেওয়া হয়েছে। সত্যি বলতে, আইন যাই বলুক, এর আগেও পরিবেশের উপর আঘাত এসেছে বিভিন্নভাবেই। পরিবেশকর্মীরা কখনও নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে নেমেছেন, কখনও ওড়িশার কালাহান্ডি রায়গড় নিয়মগিরিতে বেদান্ত কোম্পানির জমি নেওয়ার বিরোধিতা করেছেন, কখনও মুম্বইয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গাছ কেটে নগরায়ণের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। আবার আদিগঙ্গার দূষণ নিয়ে আইনের রায় থেকেছে রায়ের জায়গাতেই, সরকার বা জনতা কারোরই কোনও সদিচ্ছা দেখা যায়নি নদী বাঁচানোর জন্য। কাঁসাইয়ের বুক থেকে এত বালি তোলা হয়েছে যে, তার বালুচর মুছে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে মাটি। চৈতন্যদেবের স্মৃতিবিজড়িত কেলেঘাই নদী থেকে জল পাম্প করে তোলা হচ্ছে মাছচাষের ঝিলে জল জোগান দেওয়ার জন্য। যার জেরে নদী অববাহিকার পুরো বাস্তুতন্ত্রই বদলে গিয়েছে। এদিকে আবার যশোর রোডের শতাব্দীপ্রাচীন গাছ সাফ করার বেলায় মিলেছে আইনি শিলমোহর। গঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম হোতা গুরুদাস আগরওয়াল অনশনে মৃত্যুবরণই করেছেন, একইভাবে মৃত্যু হয়েছে নিগমানন্দ সরস্বতীরও। তাও কোথাও কোনও হেলদোল নেই কারোরই।
সব মিলিয়ে এ কথা স্পষ্ট যে, কেবল হিমালয়সংলগ্ন এলাকা নয়, গোটা দেশের নানা প্রান্তেই বিপন্ন প্রকৃতি। শাসনব্যবস্থার উদ্ধত নিস্পৃহতা, পুঁজিবাদী লোভ, জনমানসের ঔদাসীন্য, সবকিছুই সেই বিপন্নতার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও। সোনম ওয়াংচুকের অনশনের জেরে লাদাখের খবর নাহয় খুব সামান্য সামনে এল, কিন্তু বাকি দেশের এই বিপন্নতা নিয়ে আমরা আদৌ ভাবব কি?