‘মাহার’, ‘মনুবাদী’- এরকম বেশ কিছু শব্দ ছবি থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে পরিচালক বাধ্য হয়েছেন ছবিটির মুক্তি পিছিয়ে দিতে। অর্থাৎ জ্যোতিবা ফুলের জন্মজয়ন্তীতে ছবির মুক্তি সম্ভব হল না। কেবল একটি ছবির মুক্তি পিছিয়ে যাওয়া হিসাবে এ ঘটনাকে দেখা যায় না। বরং জ্যোতিবা ও সাবিত্রীবাইয়ের জীবনও যে পর্দায় বাধাহীন ভাবে দেখা গেল না, তা আধুনিক ভারতের গণতন্ত্রের গায়েই অস্বস্তিকর চিহ্ন হয়ে জেগে রইল।
জাতপাতের বিরুদ্ধে তাঁর আজীবনের লড়াই। লড়াই ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। সেই তাঁর জীবননির্ভর ছবিতেই নাকি জাত-সংক্রান্ত শব্দের ব্যবহার বাঞ্ছনীয় নয়। তাও আবার এ অভিযোগ এনেছেন ব্রাহ্মণদের গোষ্ঠীই। আর তাই স্থগিত হয়ে গিয়েছে জ্যতিবা ফুলের বায়োপিক ‘ফুলে’। এ আসলে আয়রনি ছাড়া আর কী!
আরও শুনুন: দেশে প্রথম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, লড়াইয়ের অপর নাম সাবিত্রীবাই ফুলে
১১ এপ্রিল জ্যোতিবা ফুলের জন্মদিন। সেদিনই প্রতীক গান্ধী অভিনীত ছবিটির মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। সেন্সর কর্তাদের কাটছাঁটের নির্দেশে, ছবিটির মুক্তি আপাত ভাবে স্থগিত হয়েছে। তবে, যে কারণে এই স্থগিতাদেশ তা রীতিমতো অস্বস্তিকর। অনন্ত মহাদেবন পরিচালিত এ ছবির বিষয়বস্তু জ্যোতিবা ফুলে এবং সাবিত্রীবাই ফুলের জীবন ও কার্যাবলি। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে জাতপাতের বৈষম্য এবং ভয়াবহতার কথা আসবে। আসবে, ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজব্যবস্থায় তথাকথিৎ নিচু জাতের মানুষের হেনস্তা হওয়ার বিবরণ। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই ছিল তাঁদের আন্দোলন। সেই বিন্দু থেকেই শিক্ষার প্রসার ঘটানোর ব্রত নিয়েছিলেন তাঁরা। আজকের ভারতবর্ষে যখন বৈষম্যের চিহ্নগুলো ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে, তখন জ্যোতিবা ফুলের জীবন ও দর্শন ফিরে দেখা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বইকি। তবে, ছবির ট্রেলার মুক্তির পর থেকেই এ নিয়ে বিরুদ্ধমত ঘনিয়ে ওঠে। আপত্তি ওঠে ব্রাহ্মণ ফেডারেশনের পক্ষ থেকে। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট আনন্দ দাভের মত, ছবিটির বিষয় একতরফা। ব্যাপারটা কীরকম? তাঁর অভিযোগ, ছবিতে জাতপাতকেই বড় করে দেখানো হয়েছে। আর খারাপ ভাবে দেখানো হয়েছে ব্রাহ্মণদের। জ্যোতিবা ফুলের জীবন দেখাতে গিয়ে, সমাজে ব্রাহ্মণদের অবদান অস্বীকার করা হয়েছে ছবিতে। এমনটাই অভিযোগ। এবং এর সঙ্গেই তিনি একটি শঙ্কার কথা জুড়ে দিয়েছেন, যা যথেষ্ট চিন্তাজনক। বলা হয়েছে, এ ছবি মুক্তি পেলে জাতিগত অশান্তির সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে।
আরও শুনুন: খ্যাপামি থেকে সাম্প্রদায়িক অশান্তি, উগ্র ভারতের ছক বুঝতে বারবার ভুল উদার দেশের?
জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে মানুষের জীবন আলোকসমান, তাঁর জীবনের কথা পর্দায় উঠে এলে কেন যে অশান্তি হবে, এর কোনও সদর্থক ব্যাখ্যা অবশ্য মেলে না। তবে, এই আপত্তির পর নড়েচড়ে বসেছে সেন্সর বোর্ড। ‘মাহার’, ‘মনুবাদী’- এরকম বেশ কিছু শব্দ ছবি থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে পরিচালক বাধ্য হয়েছেন ছবিটির মুক্তি পিছিয়ে দিতে। অর্থাৎ জ্যোতিবা ফুলের জন্মজয়ন্তীতে ছবির মুক্তি সম্ভব হল না। কেবল একটি ছবির মুক্তি পিছিয়ে যাওয়া হিসাবে এ ঘটনাকে দেখা যায় না। বর্তমান সময়ে এমন অনেক কাহিনিই পর্দায় বিবৃত হচ্ছে, যা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য কি-না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। ইতিহাসকে দেখা বা পর্যালোচনা করা যে এক দৃষ্টি থেকে করা সম্ভব নয়, তা সত্যি। তবে, তা কি অন্যান্য ছবির ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রযোজ্য হচ্ছে? বোধহয় তা বলা যায় না। সম্প্রতি ‘ছাওয়া’ সিনেমা নিয়ে যে বিতর্ক এবং সেখান থেকে অশান্তির ঘটনা ঘটল, তাতেও ইতিহাসের এই আংশিক ভাবে ব্যখ্যার অভিযোগই উঠেছে। স্পষ্টতই একটি নির্দিষ্ট ভাবাবেগকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে, ইতিহাসকে নৈর্বক্তিক ভাবে দেখানো হয়নি। এ কথা বলেছেন ইতিহাসবিদরাই। তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তাঁরা দেখিয়েছেন শম্ভুজি চরিত্রটিকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, আর যা ইতিহাসগত ভাবে সত্যি, তার মধ্যে অনেক ফারাক থেকে গিয়েছে। সে ছবিকে আবার রাজনৈতিক ভাবেও ব্যবহার করা হয়েছে। এক বিতর্ক দিয়ে আর এক বিতর্ককে সমর্থন করা কাম্য নয়। তবু একই সময়ে তৈরি হওয়া দুটি ছবির ক্ষেত্রে দু’রকম মনোভাব নিশ্চিতই আলোচনার দাবি রাখে। যদি একতরফা ভাবে দেখানোই ফুলের জীবনীর ক্ষেত্রে অভিযোগ হয়, এবং তার জন্য ছবিমুক্তি ব্যাহত হয়, তাহলে এ দাবিও উঠতে বাধ্য যে, কোন ছবি মুক্তি পাবে আর কোনটি পাবে না, তা-ও যেন একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ অনুযায়ীই পরিচালিত হচ্ছে।
আরও শুনুন: গুজরাট প্রসঙ্গই কাঁটা! শিল্পের স্বাধীনতা আদৌ আছে? প্রশ্ন উসকে দিল ‘এম্পুরণ’ বিতর্ক
ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থায় সমাজের অবহেলিত, প্রান্তিক মানুষদের হয়ে লড়াই করেছিলেন জ্যোতিবা ফুলে ও সাবিত্রীবাই ফুলে। তাহলে কি সেই ইতিহাস তুলে আনাই আপত্তির মূল কারণ। প্রশ্ন ঠিক এখানেই। ইতিহাসের সত্যি চাপা দেওয়া যায় না ঠিকই। তবে সিনেমার মতো জনপ্রিয় মাধ্যম জনমানসকে দ্রুত প্রভাবিত করতে পারে। সে কথা মাথায় রেখেই কি এই আপত্তির অবতারণা! প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরও জানা। তবে, সেই জানা কিংবা অজানার মধ্যেই ক্রমশ এমন এক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে, যা পছন্দসই মতকেই কেবল ছাড়পত্র দিচ্ছে। অন্য মতকে ক্রমশ কাটছাঁট করে নিজস্ব ইতিহাস রচনা করে নিতে চাইছে। এই ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদি হলে সত্যিকারের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রেই তা বাধা হয়ে উঠবে। কেননা, বিদ্যায়তনিক স্তরের ইতিহাস চর্চা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয়। দ্রুত পৌঁছয় এই ছড়িয়ে দেওয়া ইতিহাস। জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কাহিনি ছড়িয়ে পড়লে কোন শ্রেণির স্বার্থে আঘাত লাগত, সেটাই এখন ভেবে দেখার বিষয়। জানা যাচ্ছে, আগামী ২১ এপ্রিল ছবিটি মুক্তি পেতে পারে। তবে, জ্যোতিবা ও সাবিত্রীবাইয়ের জীবনও যে পর্দায় বাধাহীন ভাবে দেখা গেল না, তা আধুনিক ভারতের গণতন্ত্রের গায়েই অস্বস্তিকর চিহ্ন হয়ে জেগে রইল।