লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থীতালিকায় চোখ বোলালে দেখা যাচ্ছে, ভূরি ভূরি কোটিপতি ব্যক্তি রয়েছেন তালিকায়। প্রতি নির্বাচনে এমন প্রার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে বই কমছে না। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি প্রার্থী বাছাইয়ের সময় গুরুত্ব পাচ্ছে সম্পত্তির হিসেবনিকেশও?
ভোটের আগে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়ই সামনে আসে প্রার্থীদের সম্পদের খতিয়ান। আর সেই খতিয়ান দেখে ক্রমশই চমকে যাচ্ছে গোটা দেশ। দেশের জিডিপি কমুক বা বাড়ুক, মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়ে ফেলুক, তাতে কিন্তু এই তালিকায় বিশেষ তারতম্য চোখে পড়ছে না। অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে ইন্ডিয়া যে সত্যিই শাইনিং, তা স্বীকার না করার সুযোগ নেই। আমজনতার মধ্যে গরিবের সংখ্যা বাড়তেই পারে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রার্থীদের মধ্যে ধনীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। দল মত নির্বিশেষে সম্পত্তির বিচারে এ ওকে টেক্কা দিচ্ছেন প্রার্থীরা। আর সেখানেই উঠে আসছে একরকমের আশঙ্কা। ধন যার, ভোটও তারই- নির্বাচনী আবহে এমনই সমীকরণ ক্রমশ মান্যতা পাচ্ছে কি না, উঠছে প্রশ্ন।
আরও শুনুন:
জোট বিনে গীত নাই! স্বাধীনতার আগে থেকেই ভোটে শুরু জোট-যাত্রা
সম্পত্তির হিসেব বলছে, ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী সাংসদদের গড় সম্পদ ছিল চার কোটি, যা সেই বছরের দেশের গড় মাথাপিছু আয়ের প্রায় তিনশো গুণ। ২০১৪ সালে এই গড় সম্পদ যা ছিল, উনিশের নির্বাচনে তা ৪০ শতাংশ বাড়ে, আর চব্বিশের নির্বাচনে তা সাড়ে চার কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত, কোটিপতি প্রার্থীর অনুপাত ১৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৯ শতাংশ। আর চব্বিশের ভোটে কমিশন যে তথ্য দিয়েছে, তা থেকে জানা যাচ্ছে, প্রথম দফায় দেশের ২১টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১০২টি আসনে মোট প্রার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৬১৮ জন। সম্পত্তির হিসেব নিলে দেখা যাচ্ছে, এঁদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন কোটিপতি। এক-একজনের সম্পত্তির পরিমাণ এতই বিপুল যে কেবল কোটিপতি বললেও তার পরিমাপ হয় না। কেবল লোকসভা নির্বাচন নয়, পাঁচ রাজ্যের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে বিজয়ী ৬৭৮ জন বিধায়কের মধ্যে ৫৯৪ জনই কোটিপতি।
আরও শুনুন:
‘গরিবি’ হটিয়ে ‘আচ্ছে দিন’ এল কি? দশে মিলে দেশের রাজনীতি চেনাল স্লোগানেরা
কিন্তু এই বিপুল ধনসম্পত্তি দেখে আশ্বাসের বদলে আশঙ্কার কথাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রশ্ন তুলছেন, এমনিতেই গণতন্ত্রের মধ্যে সকলের মতপ্রকাশের যে সমানাধিকার থাকা উচিত, তা সবসময় রক্ষিত হয় না। সেখানে ধনী প্রার্থীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়লে প্রশ্ন ওঠে, যোগ্য প্রতিনিধি বাছাইয়ের প্রক্রিয়াটিই পথ হারাচ্ছে না তো? সম্পদের দাঁড়িপাল্লায় মেপেই প্রার্থীকে তুলে আনা হচ্ছে না তো কোনোভাবে? তাহলে একে তো দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ কেবল কম সম্পত্তি থাকার কারণেই জনপ্রতিনিধিত্বের সুযোগ হারাবেন। উপরন্তু, ধনের বিনিময়ে প্রার্থী হলে, নির্বাচনকে এক ধরনের বিনিয়োগ হিসাবে দেখবেন প্রার্থীদের একাংশ, এ কথাও স্পষ্ট। ফলে জয়ের সম্ভাবনা যত বাড়ছে, নির্বাচনে টাকা ছড়ানো, লেনদেনের প্রবণতাও ততই বাড়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রার্থী বাছাই এবং ভোটদান, দু’ক্ষেত্রেই কিন্তু বিপন্নতার মুখে পড়ছে গণতন্ত্র। ক্ষমতার গণতন্ত্রায়ন ঘটছে না, উলটে বাড়ছে ধনীর ক্ষমতায়ন। সব মিলিয়ে আম মানুষের পরিসর সংকুচিত হয়ে সংকটে পৌঁছে যাচ্ছে গণতন্ত্র। তা ছাড়া আরও একটি আশঙ্কা উঠে আসছে এক্ষেত্রে, তা হল, রাজনীতিতে সম্পত্তির চোরাগোপ্তা চলাচল আসলে দুর্বৃত্তায়ন বাড়ায়। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস-এর সমীক্ষা বলছে, সম্পদশালী প্রার্থীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে অপরাধের অভিযোগসম্পন্ন প্রার্থীর সংখ্যাও। চলতি নির্বাচনের আগে রাজ্যসভায় যে সাংসদেরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত, এদিকে তাঁদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১৯ হাজার কোটি টাকা। এমনকি বাংলাতেও ১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী, ৩১ জন কোটিপতি সাংসদের মধ্যে ২৩ জন অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ বিভিন্নভাবেই নির্বাচনকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে ধনী প্রার্থীদের হার বেড়ে যাওয়া, যা আদতে গণতন্ত্রের পক্ষেই সমস্যাজনক।