চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে অন্যতম চর্চিত বিষয় ছিল মঙ্গলসূত্র বিতর্ক। রাজস্থানের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি মন্তব্য থেকেই এর সূত্রপাত। তা সেই জেলার বাসিন্দারা কি মেনে নিয়েছিলেন এই বক্তব্য? ভোটের ফলাফলেই ছিল সেই জবাব। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ভোটকে যুদ্ধ ঘোষণা করে যেভাবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হয়েছে, তার জোরাল সমালোচনা করেছেন সংঘপ্রধান মোহন ভাগবত। চব্বিশের লোকসভার দিকে তাকালে দেখা যাবে, তাঁর এই মন্তব্যের নির্দিষ্ট ভিত্তি আছে। যে বিষয়টি নিয়ে সবথেকে বিতর্ক ঘনিয়ে ওঠে, তার শুরুটা হয় নরেন্দ্র মোদির একটি মন্তব্য থেকে। নিজের বক্তব্যে মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেওয়ার যে প্রসঙ্গ তিনি তুলেছিলেন, তা শোরগোল ফেলেছিল গোটা দেশে। বিরোধী শিবির প্রায় একজোট হয়ে এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু যে ছোট্ট জেলায় এই ঘটনার সূত্রপাত, সেখানকার জনতার রায় ছিল কোনদিকে?
আরও শুনুন: ভোট যুদ্ধ নয়, সমাজে বিভেদও বাড়িয়েছে! ভাগবতের সমালোচনায় বদলাবে ভোটের হাওয়া?
জেলার নাম বাঁশওয়াড়া। গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ সীমান্তসংলগ্ন এই জেলা মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত। এখানেই জনসভা করার সময় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানান মোদি। টেনে আনান কংগ্রেসের পুরনো ইস্তাহারের বয়ান। তাঁর অভিযোগ ছিল, কংগ্রেস চায় বহিরাগত এবং যাঁদের বেশি সন্তান তাঁদের মধ্যে সম্পদ বন্টন করে দিতে। আর সেই সূত্রেই এসেছিল মঙ্গলসূত্রের কথা। সাধারণ মানুষের সম্পদের মধ্যে নারীর মঙ্গলসূত্রও থাকে। অর্থাৎ অভিযোগের সারমর্ম এসে দাঁড়ায় যে, কংগ্রেস চায় মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নিতে। তাঁর এই বক্তব্য রীতিমতো ঝড় তুলেছিল ভোটের হাওয়ায়। কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল, সুকৌশলে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের প্রসঙ্গটিকেই নির্বাচনের ন্যারেটিভে টেনে এনেছেন মোদি। কমিশনে নালিশও যায়। তাঁর এরকম মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। চলতি নির্বাচনে সবথেকে বড় বিতর্ক হয়ে দাঁড়ায় এই মঙ্গলসূত্র-মন্তব্য। যদিও পরে এই বিভাজনের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তিনি এই ধরনের রাজনীতি করেন না। কখনোই করেননি। তাঁর মন্তব্য যে কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে ছিল না, তা বারবার স্পষ্ট করে দেন তিনি। তবু বিতর্ক কিন্তু থেমে থাকেনি।
আরও শুনুন: অকারণে বাজে কথা বলা অভ্যেস! স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর এ ব্যাপারে কী পরামর্শ?
সে সব বিতর্ক পেরিয়ে ভোট অবশ্য মিটে গিয়েছে। ফলাফলের ভিত্তিতে জোটসঙ্গীদের পাশে নিয়ে নতুন সরকার গড়েছেন নরেন্দ্র মোদিই। এই আবহে একবার ফিরে তাকানো যাক সেই জেলার দিকে। সেখানকার বাসিন্দারা কি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছিল? ভোটের ফল জানাচ্ছে, এই লোকসভা কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন ভারত আদিবাসী পার্টির প্রার্থী। প্রায় আড়াই লক্ষ ভোটের মার্জিনে তিনি বিজেপি প্রার্থীকে পরাজিত করে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। এই দল যখন প্রার্থী ঘোষণা করেছিল, তখন লড়াইটা গোড়ায় ছিল ত্রিমুখী। পরে ইন্ডিয়া ব্লক আসন ভাগাভাগির সূত্রে এই দলকেই সমর্থন জানায়। ফলত ভোটের লড়াই ছিল সরাসরি বিজেপির বিরুদ্ধে। আর সেখানে জনতার রায় গিয়েছে বিজেপির বিপক্ষেই।
এরবারের ফলাফলে অনেক কেন্দ্রেই বিজেপি আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। তার মধ্যেও আলাদা করে নজর কেড়েছে রাজস্থানের এই জেলা। যেখান থেকে এবারের ভোটের সবথেকে চর্চিত বিতর্কের সূত্রপাত, সেখানকার মানুষের রায় পৃথক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বইকি! দেখা যাচ্ছে, মানুষ এই মন্তব্যকে সমর্থন করেননি। বরং তাঁরা যে এ ধরনের মন্তব্যকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন না, তাই-ই জানিয়ে দিয়েছেন গণতান্ত্রিক উপায়ে। ভোটের এই সংস্কৃতি বদলের কথাই উঠে এসেছে মোহন ভাগবতের মন্তব্যেও। যা আদতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তাও দেশের কাজের জন্য, সেই ভোটকে কেনই বা যুদ্ধ হিসাবে দেখা হবে? এ প্রশ্ন যেন শুধু সংঘপ্রধানের নয়, সাধারণ মানুষেরও। অন্তত রাজস্থানের ছোট্ট জেলার ফলাফল সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।