ভারত- ভারত আমাদের আত্মার ধনি, প্রাণের স্পন্দন। ভারত গণমানুষের অন্তরের উৎসস্থল থেকে উৎসারিত ডাক। বক্তা রাহুল গান্ধী। সদ্য সাংসদ ফিরে পেয়ে রাহুল যে তোলপাড় ফেলেছেন সংসদে, সেখানে তাঁর বক্তব্যের অনেকখানি অংশ জুড়ে থাকল এই ভারতের কথা। স্রেফ কথার কথা! বা রাজনৈতিক বক্তব্য পেশের খাতিরে উঠে আসা শব্দচয়ন! নাকি, এর নেপথ্যেও আছে এক কৌশলী রাজনৈতিক মস্তিষ্ক? আসুন সাম্প্রতিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে একবার ফিরে তাকানো যাক রাহুলের এই বক্তব্যের দিকে।
‘ভারত’ এবং ‘ইন্ডিয়া’। আমাদের দেশের ভিতর ভিতর যেন বয়ে চলেছে দুটি সত্তা। এ-কথা নতুন কিছু নয়। নানা প্রসঙ্গেই বিদগ্ধজনেরা এই প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। সম্প্রতি তা অন্য একটি মাত্রা পেয়েছে। কেননা বিজেপি বিরোধী সর্বভারতীয় যে জোট গঠিত হয়েছে, সেটির নাম ‘ইন্ডিয়া’। প্রত্যাশিত ভাবেই এর বিরোধিতা করেছে বিজেপি। এবং সেই বিরোধিতার লক্ষ্য হয়েছে বিরোধী জোটের নামটিও। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখে শোনা গিয়েছিল কৌশলী ‘কুইট ইন্ডিয়া’ ডাক। এই ‘ইন্ডিয়া’ শব্দের মধ্যে আবার কেউ কেউ খুঁজে পান ঔপনিবেশিক ছায়া। যেমন, হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি তো বলেই দিয়েছিলেন আমাদের পূর্বজরা ভারতের জন্যই লড়াই করেছিলেন। অতএব ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে একহাত নিয়ে তাঁর স্লোগান ছিল ‘ভারতের জন্য বিজেপি’। ঘটনাচক্রে রাহুল গান্ধী যখন সংসদে ফিরে বক্তৃতা রাখলেন, তখন তাঁর বক্তব্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে ফিরে এল ভারতের কথাই। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর এই বক্তব্য অন্য তাৎপর্য বয়ে এনেছে রাজনৈতিক মহলে।
আরও শুনুন: দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছুট! এবার আন্তর্জাতিক পরিষেবা শুরু করছে ভারতীয় রেল
মোদি পদবি নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে আদালতের নির্দেশেই সাংসদ পদ খোয়া গিয়েছিল রাহুলের। তারপর রাজনীতির জল বেশ খানিক গড়িয়ে গিয়েছে গঙ্গা-যমুনায়। এর মধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে মণিপুরের ঘটানা। তা নিয়ে অনাস্থা প্রস্তাবও এনেছে বিরোধীরা। কংগ্রেস শিবির চাইছিল, এই অনাস্থা প্রস্তাবের আলোচনায় সংসদে ঝড় তুলুন রাহুল। কিন্তু বিধি বাম! অতএব রাহুলকে ছাড়াই শুরু হয়েছিল সেই প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে প্রায় নাটকীয় পটপরিবর্তনে আবার আদালতের হস্তক্ষেপেই হারানো পদ ফিরে পেয়েছেন রাহুল। প্রত্যাশিত ভাবেই উল্লাসের ছায়া কংগ্রেস শিবিরে এবং বিরোধী জোটে। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের মধ্যমণি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও রাহুলের ফিরে আসায় বিরোধী জোটের শক্তি বাড়ল বলেই মত প্রকাশ করেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে দেশের রাজনীতি যেন অপেক্ষাই করছিল রাহুলের প্রাসঙ্গিক প্রত্যাবর্তনের। সেই সাধ মিটিয়ে রাহুল এলেন সাংসদে, এবং ঝড় তুললেন মণিপুর নিয়ে।
লক্ষ্যণীয় যে, রাহুল ফিরে এসে যে বক্তব্য রাখলেন, সেখানে ফিরে এল ভারতমাতার কথা। কী বললেন রাহুল? বললেন, মণিপুরে ভারতমাতাকেই হত্যা করেছে বিজেপি। ভারতবর্ষের কণ্ঠস্বরকে হত্যা করা হয়েছে। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে মণিপুরকে। বললেন, তিনি ‘মণিপুর’ শব্দটি উচ্চারণ করছেন বটে। কিন্তু কোথায় সেই মণিপুর! বিজেপি তো তাকে টুকরো করে ফেলেছে। রাহুলের ইঙ্গিত, এই কি তাহলে ভারতমাতা!
আরও শুনুন: ‘পাকা বাড়ি করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ’, বৃদ্ধার লেখা চিঠি ভাগ করে নিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি
এই ‘ভারতমাতা’ চিত্রকল্পটি বরাবরই ব্যবহার করেন বিজেপি নেতারা। দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে যে কোনও স্তরের নেতারাই দেশকে ‘ভারতমাতা’ হিসাবে তুলে ধরতে সমান আগ্রহী। ‘ইন্ডিয়া’ জোট ঘোষণা হওয়ার পর হিমন্ত বিশ্বশর্মার ট্যুইটের কথাই স্মরণ করা যাক। তাঁর দাবি ছিল, ‘ইন্ডিয়া’ নামটি তো ইংরেজদের দেওয়া। ভাবনার সেই ঔপনিবেশিক শিকল থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। এবং বিজেপি তাই ভারতের জন্যই কাজ করবে। অর্থাৎ ভারত, ভারতমাতা এবং বিজেপিকে এক সমীকরণে টেনে তুলে এনেছিলেন তিনি। এদিন রাহুল যখন মণিপুর প্রসঙ্গে সেই ভারতমাতার ছবিই তুলে ধরলেন তখন উদ্বেল হল সংসদ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, নয়া পর্বে বিজেপির পথে হেঁটেই বিজেপিকে আক্রমণের ক্ষুরধার পথটি বেছে নিয়েছেন রাহুল। আর তাই তাঁর বক্তব্যে বারবার ফিরে এল ভারতের কথা। ‘ভারত’ যে দেশের মানুষের অন্তরের গভীরে জেগে থাকা ধ্বনি, সেই কথাটিই তুলে ধরলেন রাহুল। আর ভারত বনাম ইন্ডিয়ার যে ভাগটি ক্রমাগত করে চলেছিল শাসক শিবির, সেই অস্ত্রের তীক্ষ্ণ মুখটিকেই যেন ভোঁতা করে দিলেন।
আরও শুনুন: মাঠে নেমে কৃষকদের পাশে রাহুল, আবারও সেই ‘ভারত জোড়ো’র বার্তা?
ভারত জোড়ো পর্ব থেকেই রাহুল জানান দিচ্ছিলেন যে তিনি সেই বিজেপি-কল্পিত ‘পাপ্পু’ নন। এ যেন ‘রাহুল 2.0’! বিজেপি ও সংঘ পরিবারের আদর্শের বিরুদ্ধে তাঁর সরাসরি সংঘাত। আর সে-সংঘাত রাজনৈতিক ভাবেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ক্রমাগত। দেশ ও দেশ সম্পর্কিত সমস্ত ধারণা, চিত্রকল্প, উপমা যে কেবল বিজেপি আর সংঘ পরিবারের নয়, সেই কথাটি রাহুল স্পষ্ট ভাবে এবং ঠারেঠোরেও বুঝিয়ে দিতে চাইছিলেন। স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির মুখে উঠে এসেছিল যে ‘ফকির’-এর উপমা, রাহুল যেন তার প্রতিষ্পর্ধী হয়ে উঠলেন তাঁর পরিব্রাজক চেহারায়। অনেকেই সে সময় রাহুলকে দেখে বলেছিলেন, ইনি তো আধুনিক ভারতবর্ষের ফকির কিংবা সন্ন্যাসী। যিনি হাঁটছেন দেশের মাটিতে, আর বার্তা দিচ্ছেন ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালবাসার। বোঝা যাছিল, বিজেপির যে রাজনৈতিক বয়ান তারই পালটা দিতে চাইছিলেন রাহুল। এদিন সংসদে রাহুলের বক্তব্য যেন তারই এক প্রসারিত রূপ। সাংসদ না-থাকলেও, বিজেপির তৈরি করা ভারত বনাম ইন্ডিয়া ন্যারেটিভের দিকে নজরই রেখেছিলেন রাহুল। আর তাই সংসদে ফিরে তিনি সেই ন্যারেটিভটিকেই ভেঙে দিলেন নিজস্ব কায়দায়। বুঝিয়ে দিলেন, ভারত শুধু বিজেপির নয়। ভারত মানুষের বুকে জেগে থাকা সত্যি। আর তাঁকেই হত্যা করছে বিজেপি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কৌশলী রাহুল বিজেপির হাতিয়ার ব্যবহার করেই তাদের আক্রমণ ভোঁতা করায় ক্রমশ সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন।
আরও শুনুন: কর্ণাটকে হারেও মার নেই, জনপ্রিয়তায় শীর্ষে সেই মোদিই, তবে এগোচ্ছেন রাহুলও
ভারত বনাম ইন্ডিয়া- ছিল বিজেপির রাজনীতি। পালটা চাল দিয়ে রাহুল যেন জানিয়ে রাখলেন, ইন্ডিয়াও আসলে ভারত-ই। আর সেই ভারতকে বুকের গভীরে লালন করার দায় শুধু বিজেপির নয়। তা যেমন বিরোধীদের, তেমন বৈচিত্রে ভাস্বর এই দেশের অগণিত মানুষের মনেই জেগে থাকে সেই ভারতের ধারণা।