কবি হিসেবে যে-রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনি, সেই ভাবুক শিল্পীর থেকে আলাদা একজন মানুষ ঔপনিবেশিক ভারতে দাঁড়িয়ে নিজস্ব স্বদেশভাবনা এবং তার বাস্তবায়নে মন দিয়েছিলেন। পরাধীন ভারতের ভিতর থেকে যে দেশ নির্মাণ, তা নিয়ে তেমন করে কেউই সেভাবে ভাবছিলেন না। আবার নেতারা যেভাবে দেশ তুলে ধরার চেষ্টা করছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার অনুসারী ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের দেশভাবনা তাই বরাবরই পৃথক গুরুত্ব দাবি করে। আর সেই ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতেই তিনি জোর দিয়েছিলেন শিক্ষায়।
কেমন হবে সেই শিক্ষা? যে-শিক্ষা ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে চাকরির জন্য ভদ্রলোক তৈরি করে, সেই চেনা খোপ থেকে বেরোতে চাইছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও সেই উনিশ শতকীয় ভদ্রলোকি ঘরানারই মানুষ। আর সেই কারণেই তিনি অনুধাবন করেছিলেন, শিক্ষার সম্পূর্ণতার কথা। যা মানুষকে চাকুরীজীবি নয়, বিশ্বনাগরিক করে তুলবে। এই দর্শনই মূর্ত হল বিশ্বভারতী রূপে। আসলে তিনি এমন একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন, যা হয়ে উঠবে ঔপনিবেশিক ছকের পালটা বয়ান। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে নয়, শিশুদের জন্য গোড়ার শিক্ষা থেকেই সেই ছক ভাঙার চেষ্টার সূচনা করেছিলেন তিনি। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার একুশ বছর আগে, ১৯০১-এ, তা শুরু হয়েছিল ব্রহ্মচর্যবিদ্যালয় নামে। এই স্কুলের পিছনে ছিল রবীন্দ্রনাথের শিশুশিক্ষা সম্বন্ধে একটি সম্পূর্ণ নতুন দর্শন, যা তখনকার উপনিবেশের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাপ্রণালীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ একে একরকম প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেই দেখা যেতে পারে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই অন্যরকম শিক্ষাভাবনা নিয়ে আলোচনার আড়ালে আরও একটি কথা থেকে যায়, তা হল, এই প্রতিবাদ ধীরে ধীরে আর একমুখী হয়ে থাকছিল না। কেবল শিক্ষা বা সংস্কৃতিই নয়, সমাজ ও রাজনীতিকেও ক্রমশ সেই প্রতিবাদের পরিসরে অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই দেখা গেল, ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয় ছিল অনেকটা প্রাচীন ভারতের তপোবন ভাবনার অনুসারী, কিন্তু ১৯১০ সালে তাঁর আশ্রম বিদ্যালয় ভাবনার মধ্যে সেই তপোবনের রূপবদল ঘটছে। তাঁর মনে ভারতসংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র স্থাপনের যে ভাবনা ছিল, নোবেল জয়ের পর জাপান ও আমেরিকা সফর সেই ভাবনাকে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগে বদলে দিল, এমনটাই মনে করছেন কৃষ্ণ কৃপালনি। যে উদ্যোগের নেপথ্যে ছিল বিশ্ববোধ।
আরও শুনুন: গোড়ার শান্তিনিকেতনে ছাত্র নেই, বিদেশি অধ্যাপকের ক্লাসে ছাত্র হয়ে বসলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ
আসলে সেই সময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আবহে ন্যাশনালিজমের বিপদ-আপদ সংকট নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, যুদ্ধোন্মাদ পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলি তার নাগরিকদের ওই যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য হাতের যে তাসটা খেলে চলেছে তার নাম ‘ন্যাশানালিজম’। এই ‘ন্যাশানালিজম’ পদার্থটার মধ্যে একরকম সংকীর্ণতা আছে। আপন দেশকে শ্রদ্ধা করার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ নয়; অন্য দেশ বা জাতিকে খাটো না করে সংকীর্ণ ন্যাশানালিজম যেন চলতেই পারে না। একেই সংকট বলে ভাবছেন তিনি, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপদ নিয়ে নিরন্তর কথা বলে চলেছেন বিদেশের সভাগুলিতে, আর সেই প্রেক্ষিতে একাধিক চিঠিতে বারবার বলছেন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে গড়ে তোলার কথা। এই সময়েই অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতে জাতিবিদ্বেষের যে প্রকাশ ঘটে, তার প্রতিক্রিয়ায় শিকাগো থেকে জগদানন্দ রায়কে তিনি লেখেন- “Nationalism হচ্ছে একটা ভৌগোলিক অপদেবতা, পৃথিবী সেই ভূতের উপদ্রবে কম্পান্বিত – সেই ভূত ছাড়াবার দিন এসেছে। কিছুদিন থেকে আমি তারি আয়োজন করচি। দেবতার নাম করলে তবেই অপদেবতা ভাগে। …আমাদের বিশ্বভারতীতে সেই দেবতার মন্দির গাঁথচি। দেশের নাম করে এখানে যদি আমরা কোনো বাধা দেবার বেড়া তুলি তাহ’লে দেবতার প্রবেশপথে বাধা দেওয়া হবে।” অর্থাৎ এ কথা স্পষ্ট যে, তাঁর বিশ্বভারতী-ভাবনা উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণার বিপরীতে এক পালটা প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথের স্বতন্ত্র প্রকল্প, যে প্রকল্পের মূল ভাবনায় প্রোথিত রয়েছে এক দিকে ‘বিশ্ব’ আর অপর দিকে ‘ভারত’-এর ধারণা। সমগ্র বিশ্বের ধারণার নীড় বা আধার হয়ে উঠবে বিশ্বভারতী, আর প্রতিহত করবে উপনিবেশবাদ, পুঁজিবাদ, অথবা জাতীয়তাবাদের বিবিধ ক্ষমতাকেন্দ্রিক ধারণাকে- এমনটাই ছিল এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের নেপথ্যে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা প্রকল্পের এই ধারণা শান্তিনিকেতনের আশ্রম-বিদ্যালয়ের হিন্দুবাদী অথবা জাতিভেদবাদী ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ধারণার থেকে স্পষ্টতই আলাদা। ১৯১৬ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকেও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, “শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে… স্বাজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসচে– ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাতিক মহামিলন যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্চে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে।” একজন কৌশলী চিন্তাবিদ হিসেবেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের আগ্রাসনকে রোখার জন্য প্রাচীন ভাষা, নৃতত্ত্ব, সংস্কৃতি ও দর্শনকে ছুঁয়ে ছেনে বিশ্বভারতীর কাঠামো নির্মাণের চেষ্টা করে চলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও শুনুন: মুসলিমদের কোরবানি আটকাতে নালিশ হিন্দু প্রজাদের, কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রশাসক রবীন্দ্রনাথ?
বর্তমানে গোটা ভারত জুড়েই সেই সংকীর্ণ ন্যাশনালিজমের চর্চা শুরু হয়েছে, দেখা যায়। এদিকে নানা বিতর্ক সম্প্রতি দেখা দিয়েছে বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করেও। সে অমর্ত্য সেনকে নিয়ে বিবাদ হোক কিংবা কাশ্মীর ফাইলস-এর অভিনেতাকে বক্তৃতা দিতে ডাকা। দেখা গিয়েছে, নানা ইস্যুতেই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিক্ষিত সাধারণ বাঙালির চিন্তাভাবনার যেন তালমিল হচ্ছে না। এই আবহেই এল বিশ্বস্বীকৃতি। মনমোহন সিং যখন সরকারে ছিলেন, তখনই এই প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল। ক্ষেত্রঘটিত জটিলতায় তখন তা বিবেচনাধীন থেকে যায়। এতদিন পর এল সেই স্বীকৃতি, বাঙালির কাছে তা নিঃসন্দেহে আনন্দের। তবে, তার পাশাপাশি গোড়ার প্রশ্নটিকেও উড়িয়ে দেওয়া যায়। বিশ্বনাগরিক তৈরির জন্য, সম্পূর্ণ শিক্ষার জন্য এবং ঐতিহ্য-আধুনিকতার মেলবন্ধনে যে মানুষ গড়তে তিনি চেয়েছিলেন, তা কি আজকের এই সংকীর্ণতার চর্চার যুগে বজায় রাখা সম্ভব! হেরিটেজ স্বীকৃতি নিশ্চিতই আমাদের গৌরব বাড়াল। তবে, রবীন্দ্রভাবনার সেই বিশ্বভারতী যদি অক্ষুণ্ণ না রাখা যায় তবে বাঙালির কাছে তার থেকে বড় লোকসান আর কিছু হবে না।