আর জি কর ধর্ষণ কাণ্ডে উত্তাল দেশ। যে চিকিৎসক তরুণী কর্মক্ষেত্রেই ধর্ষণ ও মৃত্যুর শিকার হলেন, তাঁর জন্য ন্যায়বিচারের দাবিতে গর্জন উঠেছে। অথচ অন্যদিকে খবর বলছে, পর্ন সাইটে খোঁজ চলছে সেই ধর্ষিতা মেয়েরই। এই চূড়ান্ত বিরোধী দুই ছবির মাঝে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা?
মেয়েরা রাতে বিপন্ন, মেয়েরা দিনেও বিপন্ন। মেয়েরা বাইরে বিপন্ন, ঘরেও তারা নিরাপদ নয়। আর জি কর কাণ্ডের প্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই নিরাপত্তাহীনতার বোধ। নিজেরই চেনা কর্মক্ষেত্রে, নিজের কাজের পরিসরে এক চিকিৎসক তরুণী যে ধর্ষণ খুনের শিকার হতে পারেন, সে ঘটনা যেন সমস্ত মেয়ের অস্তিত্ব ধরে টান দিয়েছে। আর কেন এই বিপন্নতা বিচ্ছিন্ন না হয়ে সামগ্রিক হয়ে উঠেছে, তার উত্তর দিতেই যেন সামনে এসেছে আরও এক খবর। যেখানে জানা যাচ্ছে, যে মারাত্মক অপরাধের কথা আমাদের আমূল কাঁপিয়ে দিয়েছে, সেই অপরাধের লাইভ ভিডিওর চাহিদা আপাতত তুঙ্গে। পর্ন সাইটের সার্চ তালিকায় সে চাহিদা স্পষ্ট। আর জি করের ধর্ষিতা চিকিৎসক তরুণীকে সেখানে খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রবৃত্তিতাড়িত কিছু মানুষ। একদিকে যখন নির্যাতিতার জন্য ন্যায়বিচারের দাবি গর্জনে ফেটে পড়ছে, অন্যদিকে সামনে আসছে প্রবৃত্তির এই অন্ধ তীব্র চেহারা। যেখানে প্রবল যন্ত্রণা সয়ে মরে যাওয়া মেয়েও নিছক ভোগ্য। নেহাতই পণ্য। অনেক মানুষের কাছে সে তখনও বিনোদন। কোনও এক বা একাধিক ধর্ষককে যদি চিহ্নিত করাও যায়, এই ভাবনা নিয়েই আরও অনেক গোপন ধর্ষক তো রয়েই যাচ্ছে আমাদের চারপাশে। যা নিয়ত বিপন্ন করে রাখছে মেয়েদের।
আরও শুনুন:
ধর্ষণে অভিযুক্তরা যদি ভোটে দাঁড়ান, বিচারের দাবি যাবে কোথায়?
মনে পড়ে ২০১৮ সালের সেই জানুয়ারি মাসের কথা। কাঠুয়ার বাসিন্দা আসিফা বানো একাধিক লোকের লালসায় ঝলসে গিয়েছিল। তার বয়স তখন বছর আট। নৃশংস সেই ঘটনায় উত্তাল হয়েছিল জাতীয় রাজনীতি। প্রতিবাদে সরব হয়েছিলাম আমরা। সেই সময়ে ভাইরাল হয়েছিল একটি স্ক্রিনশট, যেখানে দেখা যাচ্ছিল একটি পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটে সার্চের শীর্ষে চোখ ঝলসে দিচ্ছে একটি ছোট্ট নাম, আসিফা। এবারও সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া একাধিক স্ক্রিনশট বলছে, গত কয়েকদিন যাবৎ পর্ন সাইটে দলে দলে যৌন বুভুক্ষুরা খুঁজে বেড়াচ্ছে আর জি করের ধর্ষিতা তরুণীকে। এর আগেও শোনা গিয়েছে, জ্যোতি, প্রিয়াঙ্কা, একের পর এক নাম জুড়েছে ধর্ষণের তালিকায়, আর ততই নতুন নতুন আকর্ষণ যোগ হয়েছে এক শ্রেণির পর্ন-দর্শকের সার্চ লিস্টে।
আরও শুনুন:
ছলনা করেই অবলা রমণীর সর্বনাশ! পুরুষদের সম্পর্কে লিখেছিলেন আর জি করের ‘সঙ্গিনী’
ধর্ষিতা, পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের জন্যে কাজ করেন সুনীতা কৃষ্ণন। তিনি জানান, ধর্ষণ ভিডিও বাজারকে বলে ‘রেপ ইন্ডাস্ট্রি’। ধর্ষণ করে সেই ভিডিও ক্যামেরায় তুলে রেখে অশ্লীল ছবির বিশ্ববাজারে চড়া দামে বিক্রি করে অপরাধীরা। পর্ন সাইটেও ছড়িয়ে যায় সেসব ভিডিও। কারও মুখ দেখা গেলেও পুলিশ ততক্ষণ নড়েচড়ে বসবে না, যতক্ষণ না কেউ অভিযোগ জানাচ্ছেন। সে অভিযোগও নাম গোপন করে জানানোর উপায় নেই। যেখানে এমনিই ধর্ষণের অভিযোগ নিতে টালবাহানা চলে, অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয় বলে শোনা যায়, সেখানে এ অভিযোগে কতখানি কাজ হবে তাও সন্দেহ। তবে সেও পরের কথা। যারা ভিডিও করছে বা সে ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য লড়াই চালাচ্ছেন সুনীতারা। কিন্তু ভিডিও দেখার জন্য যারা আগেভাগেই বসে আছে? যারা নিজেরা হয়তো ধর্ষণ করেনি, কিন্তু ওই নৃশংস অত্যাচার তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার জন্য ওঁত পেতে আছে? তাদের চিহ্নিত করা যাবে কেমন করে! ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা এইসব ধর্ষকামী মানুষের সামনে প্রতিদিন আরও, আরও বিপন্ন হতে হবে মেয়েদের। একটি ধর্ষণের খবর সেই অতল বিপন্নতার মুখ খুলে দিল ফের।