দেশের সংবিধানকে সঙ্গে নিয়েই রাহুল বুঝিয়েছেন, দেশটা কোনও দলের নয়। দেশটা মানুষের। মানুষও এতদিনে রাহুলকে তাই ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁর হৃত সম্মান। কটাক্ষের যে চোখা শব্দ এক সময় তাঁর দিকে ছুটে যেত, আজকাল আর তা যায় না। বরং কোথাও গিয়ে দেশের অনেক অনেক মানুষ বুঝেছেন, রাহুলের পথ ধরেই দেশের সঙ্গে দেখা হবে দেশের মানুষের।
ফল প্রকাশের পর সেই কথাটুকু জানিয়েই বোন লিখেছেন, দাদার জন্য তাঁর গর্ব হয়। তিথি-নক্ষত্র নাই মিলুক, সে ট্যুইট যেন তাই রাহুলের কপালে ফুটে উঠল ভাইফোঁটা হয়েই।
দাদাকে সমানে ‘পাপ্পু’ বলে যেতেন অনেকে। কোন বোনেরই বা তা শুনতে ভালো লাগে! প্রিয়াঙ্কা গান্ধীরও নিশ্চয়ই লাগত না। তবে, তাঁর দাদা তো বেশ একবগগা, এককাট্টা। কারও খোঁটা শুনে নিজের আদর্শ-দর্শন থেকে সরে আসার বান্দা তিনি নন। রাহুল গান্ধী সরেও আসেননি। বরং যে রাজনৈতিক বয়ান তাঁকে ‘পাপ্পু’ বানাতে চেয়েছিল, সে রাজনীতির জবাব তিনি দিয়েছেন রাজনৈতিক ভাবেই। আর তাই কংগ্রেস-সহ ‘ইন্ডিয়া’ জোট যখন চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে ফলাফল করে বিজেপিকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থকে সরিয়ে দিয়েছে, তখন আদরে আদরে দাদাকে ভরিয়ে দিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। বলেছন, দাদার কীর্তিতে তিনি গর্বিত।
আরও শুনুন: জোট বাঁধলে হতে পারে কার্যসিদ্ধি, বুঝিয়েছিল রামায়ণ-মহাভারতই
ভারতীয় রাজনীতিতে রাহুল গান্ধী সত্যিই এক বিস্ময়কর চরিত্র। এমনভাবে তলিয়ে যেতেও বোধহয় কাউকে দেখেনি। আবার ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিরে আসার এমন নমুনাও সহজে মেলে না। যে গান্ধী পরিবার গোটা ভারতবর্ষের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আছে, রাহুল একদিন যেন বিস্ময়ে খেয়াল করলেন, সেই পরিবারই তাঁর রাজনৈতিক পথের প্রথম এবং প্রধান কাঁটা। ভোটের রাজনীতিতে কেউ ক্ষমতাচ্যুত হতেই পারেন। কিন্তু রাহুলের ক্ষেত্রে গোটা জীবনটাই যেন হয়ে উঠল একটা রাজনৈতিক মশকরা। তাঁর বিরোধীরাই সেই বয়ান নির্মাণ করেছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর পরিচয় হয়ে দাঁড়াল ‘পাপ্পু’। রাজনীতিতে পারিবারিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে একটা দল, রাহুল গান্ধীকেই যেন ছোট করে দিলেন অনেকখানি। গোটা দেশের মনে এই বিশ্বাস চারিয়ে দেওয়া হল যে, রাহুলের পক্ষে কোনও কিছুই করা সম্ভব নয়, দেশ চালানো তো দূরের কথা। একটা সময় দলের ভাঙনও ধরে রাখতে পারেননি রাহুল। বিরাট কংগ্রেসের যৌথ পরিবার যত ভাঙতে থাকল, বিরুদ্ধ বয়ান তত প্রখর হয়ে উঠল। রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ তো দূরের কথা, ব্যক্তি রাহুলকেই একটা তামাশার জায়গায় নিয়ে চলে গেলেন তাঁর বিরোধীরা। বলা জরুরি, রাহুলের ক্ষেত্রে বাকিটা ব্যক্তিগত বলে আর কিছু রইল না। বরং তাঁর কাছে ব্যক্তিগত যা কিছু সবটুকুই হয়ে উঠল রাজনৈতিক।
আরও শুনুন: রামের অযোধ্যায় জিতলেন একজন দলিত নেতা, কে এই অওধেশ প্রসাদ?
রাহুল ঝড় সামলেছেন। বিপর্যয় সামলেছেন। কিন্তু বেসামাল হয়ে পড়েননি একবারও। নিজের আদর্শে তিনি ছিলেন নিষ্ঠ। তাঁর দিকে কটূক্তি ছুড়ে দিলে তিনি পালটা কটূক্তি করেননি। তাঁর প্রতি অবিরাম ঘৃণা বর্ষিত হলেও, তিনি ঘৃণার বয়ানকে সরিয়ে রেখেছেন। বুঝিয়ে দিলেন, বদলাপুরের রাজনীতি তাঁর রাস্তা নয়। বদলে তিনি কী করলেন? তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের চোখের সামনেই তাঁর ভাবনার ভারতবর্ষ পুনরুদ্ধার করতে শুরু করলেন। ঘৃণার বদলে তাঁর হাতিয়ার হল ভালোবাসা। ঘৃণা, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে দেশ জীর্ণ। দেশবাসীর চোখের সামনেই একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে দেশ। রাহুল সেই অবিমিশ্র ঘৃণার ভিতরই হাঁটতে হাঁটতে বলতে শুরু করলেন তাঁর ভারতবর্ষের কথা। বললেন, হাতে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে থাকার কথা। ভারত-জোড়ো-যাত্রার রাজনৈতিক সুফল কী হবে তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন বিশেষজ্ঞরা। রাহুলের দ্বিধা ছিল না। পরর্তীতে তিনি শুরু করেন ন্যায় যাত্রা। যে ন্যায় শব্দের প্রসারিত অর্থ ধর্মও বটে। এককালে অনেকে মজা করে বলতেন, রাহুল নরম হিন্দুত্বের পথ ধরেছেন। কিন্তু যাঁরা ঘোষিত হিন্দুত্ববাদী তাঁদের সঙ্গে এভাবে লড়াই করা যায় না। রাহুলের সময় লাগল বটে, তবে তিনি ক্রমে বোঝাতে পারলেন তাঁর রাস্তাটি। সে রাস্তাটি কোনও সম্প্রদায়বিশেষের নয়। বরং ভারতবর্ষ ধর্ম বলতে যে ন্যায়-নীতি-ন্যায্যতার কথা জানত, সেটাই তাঁর রাস্তা। রাহুল বুঝেছিলেন, এই ভারতবর্ষের শুশ্রূষা সহমর্মিতা অর্থাৎ এমপ্যাথি। তা না থাকলে মানবতার জায়গাটিতে পৌঁছনো যাবে না। যে মানবতা ও ভালোবাসার কথা বলেন হিউম্যানিস্টরা, কার্যত রাজনৈতিক যাত্রায় সে কথাই বলেছিলেন রাহুল। ভোটবাক্সের রাজনীতি তখনও তাঁকে নানা ভাবে মাত দিচ্ছে। তবে রাহুল স্পষ্ট করে দিতে পেরেছিলেন যে, তাঁর রাজনীতি শুধু নির্বাচনী অঙ্কে আটকে নেই। ভারতীয় রাজনীতি সম্প্রতি যে বিভাজন ও একনায়কতন্ত্রের মুখে পড়েছে বলে বহু মানুষই আক্ষেপ করেন, রাহুল সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা পালটা বয়ান তৈরি করতে পেরেছিলেন। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল জানাচ্ছে, রাহুল তা পেরেছেন বেশ ভালোভাবেই। সরকারে হয়তো তিনি আসেননি। তবে বিরোধী পরিসরের জায়গাটিকে চাঙ্গা করে, দেশের গণতন্ত্রকেই অনেকটা অক্সিজেন জুগিয়েছেন।
আর সেই পথটুকু তিনি পার হয়েছেন শান্ত, মার্জিত, শিষ্ট ভাবেই। দেশের সংবিধানকে সঙ্গে নিয়েই রাহুল বুঝিয়েছেন, দেশটা কোনও দলের নয়। দেশটা মানুষের। মানুষও এতদিনে রাহুলকে তাই ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁর হৃতসম্মান। কটাক্ষের যে চোখা শব্দ এক সময় তাঁর দিকে ছুটে যেত, আজকাল আর তা যায় না। বরং কোথাও গিয়ে দেশের অনেক অনেক মানুষ বুঝেছেন, রাহুলের পথ ধরেই দেশের সঙ্গে দেখা হবে দেশের মানুষের।
ফল প্রকাশের পর সেই কথাটুকু জানিয়েই বোন লিখেছেন, দাদার জন্য তাঁর গর্ব হয়। তিথি-নক্ষত্র নাই মিলুক, সে ট্যুইট যেন তাই রাহুলের কপালে ফুটে উঠল ভাইফোঁটা হয়েই।