দরজায় দরজায় গিয়ে ভোট চাওয়ার রীতিতে এবার হয়তো ভাটার টান। নতুন যুগে প্রচারের নয়া পন্থার দিকে ঝুঁকছে সব রাজনৈতিক দলই। আর সেখানেই দেখা যাচ্ছে, সোশাল মিডিয়ার ইনফ্লুয়েন্সাররা ক্রমশ হয়ে উঠছেন এই প্রচারের নতুন হাতিয়ার। যাঁদের গায়ে সেভাবে রাজনীতির ছাপ নেই, তাঁরা কীভাবে বড় ভূমিকা নিচ্ছেন এক্ষেত্রে?
নরেন্দ্র মোদির আমলে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’। ২০২৩ সালে গান্ধী জয়ন্তীর প্রাক্কালে দেখা গিয়েছিল, এই প্রকল্পে ঝাড়ু হাতে নিজেই ময়দানে নেমেছেন প্রধানমন্ত্রী। আর তাঁর সঙ্গী কোনও নেতা মন্ত্রী নন, বরং বছর তিরিশের এক যুবক। জানা যায়, অঙ্কিত বৈয়ানপুরিয়া নামের ওই যুবক হরিয়ানার কুস্তিগির, তবে চোট আঘাতের কারণে কুস্তি ছেড়ে আপাতত ফিটনেস ভিডিও বানান তিনি, আর সেই কারণেই সোশাল মিডিয়া জুড়ে রীতিমতো খ্যাতিও কুড়িয়েছেন। কেবল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই নয়, ফিটনেস এবং সুস্থতাকেও একইভাবে গুরুত্ব দিতে হবে, এই বার্তা দিতেই অঙ্কিতকে সঙ্গী করেছিলেন মোদি। এই ভিডিওটি অঙ্কিতকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছিল তো বটেই, একইসঙ্গে তাঁর নেটদুনিয়ার জনপ্রিয়তাকে হাতিয়ার করে আরও চর্চায় উঠে এসেছিল বিজেপির প্রকল্পটিও।
আরও শুনুন:
কৃষকদের ‘সোশাল মুখ’ বন্ধ, তাতে কি আটকানো যাবে যন্ত্রণার খতিয়ান?
এই একটিমাত্র ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক কালের রাজনীতির দুনিয়ায় এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ মিলবে, যেখানে সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের উপর ভরসা রেখেছে একাধিক রাজনৈতিক দল। রাজনীতির লড়াইয়ে কেবল রাজনৈতিক মুখদেরই দেখা যাবে, সেদিন এখন অতীত। মসনদ দখলের জন্য আরও বেশি ভোট নিশ্চিত করা জরুরি, সুতরাং আরও বেশি মানুষকে কীভাবে আকৃষ্ট করা যাবে, তা নিয়ে ক্রমাগত মাথা ঘামাচ্ছেন ভোটকুশলীরা। আর সেই আকর্ষণের পন্থা খুঁজতে গিয়ে ক্রমশই দেখা যাচ্ছে, সোশাল মিডিয়ার ইনফ্লুয়েন্সাররা হয়ে উঠছেন রাজনৈতিক দলগুলির নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার। তাঁদের অনেকের গায়ে আপাতভাবে রাজনীতির তকমাও নেই, তবুও ভোটযুদ্ধে বড় ভূমিকা নিচ্ছেন তাঁরা। যেমন রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনের আগে জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সারদের সামনে একটি প্রস্তাব রেখেছিল তৎকালীন অশোক গেহলট সরকার। বলা হয়েছিল, সরকারের প্রকল্পগুলি বিভিন্ন সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে দিন তাঁরা। বিনিময়ে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। একইভাবে লোকসভার আগে বিজেপি থেকে কংগ্রেস সব দলই একাধিক ইনফ্লুয়েন্সারের সঙ্গে কথা চালাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।
আরও শুনুন:
নেহেরুর চাঁচাছোলা সমালোচনা সাংবাদিকের, নেমে এসেছিল নিষেধের খাঁড়া?
এমনিতে রাজনীতির প্রচারে তারকাদের দেখা গিয়েছে অনেকসময়ই। আগে তো বটেই, এখনও তারকাদের প্রার্থী করার চল কম নয়। আমজনতার কাছে তাঁদের যে আকর্ষণ, তা কাজে লাগিয়েই এখানে ভোট টানার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সোশাল মিডিয়া এসে বিনোদুনিয়ার ছবিটাও অনেকখানিই বদলে দিয়েছে। বস্তুত সস্তা ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রচলনে অনেকটা বদল এসেছে গোটা সমাজেই। বিশেষজ্ঞরা যাকে বলছেন ‘জিও এফেক্ট’। Telecom Regulation Authority of India (TRAI) জানাচ্ছে, ২০২৩-এর শেষের দিকে এ দেশে নেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯২ কোটি। আর তার অন্তত ৬৭ শতাংশ মানুষ কোনও না কোনও সোশাল মিডিয়া অ্যাপ ব্যবহার করে থাকেন। এই বাজারকে ব্যবহার করেই মুনাফা ঘরে তুলছেন ইনফ্লুয়েন্সাররা। ডিজিটাল যুগের আগে রুপোলি পর্দার তারকাদের যে আকর্ষণ ছিল, এখন হাতে থাকা মোবাইলে অনেকটা ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলা ইনফ্লুয়েন্সারদের কদর তার চেয়ে কম নয় আমজনতার কাছে। আর সেই জনতার কাছে পৌঁছতে হলে এই ইনফ্লুয়েন্সারদের যে হাতিয়ার করা যেতেই পারে, সে কথা বুঝতে পারছেন রাজনৈতিক নেতৃত্বরাও। ডিজিটাল মাধ্যমকে কাজে লাগাতে এখন রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের সোশাল মিডিয়ায় অংশগ্রহণ বেড়েছে, রিল বা শটসে মুখ দেখাচ্ছেন তাঁদের অনেকেও। আর এই ক্ষেত্রকে আরও বেশি করে কাজে লাগাতে চেয়েই ক্রমশ দলগুলির তুরুপের তাস হয়ে উঠছেন সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররাও।