স্ট্যালিনে চিঠির সার কথা, ভাষার আগ্রাসন আদতে রাজনৈতিক আগ্রাসনই। ভাষার প্রতিরোধও তাই রাজনৈতিক প্রতিরোধ। যথার্থ লক্ষ্যভেদের দরুনই এর পালটা দিতে হয়েছে বিজেপিকে। কিন্তু হিপোক্রেসি কটাক্ষে কি তা সফল হবে?
রাজনৈতিক সুবিধাবাদ! হিপোক্রেসি! এই মর্মেই স্ট্যালিনের খোলা চিঠির প্রতিরোধে নেমেছে বিজেপি। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে সরব হয়েছেন অমিত মালব্য। জাতীয় শিক্ষা নীতিতে প্রস্তাবিত তিন-ভাষা নীতির বিরোধিতাতেই যে স্ট্যালিনের এই মন্তব্য, তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই, এ-কথা দ্বিধাহীন জানিয়েছেন মালব্য। তাঁর এই প্রত্যুত্তর থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, স্ট্যালিনের লক্ষ্যভদ যথার্থ।
খোলা চিঠি। ভারতবর্ষের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী লিখছেন,অন্য রাজ্যের সকল সহ-নাগরিকদের উদ্দেশে। বিষয়, অবশ্যই ভাষা। ভাষার আগ্রাসন। স্পষ্ট কথায়, হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের দরুন আঞ্চলিক ভাষার অপমৃত্যু নিয়েই সরব হয়েছেন তিনি। তাঁর খোলা চিঠিতে মাৎস্যন্যায়ের উল্লেখ। হিন্দি আগ্রাসন কতগুলো ভাষাকে যে গিলে ফেলছে তার ঠিক নেই! আক্ষেপ করেছেন তিনি। বিহার-উত্তরপ্রদেশকে ‘হিন্দি হার্টল্যান্ড’ হিসাব তুলে ধরার বিরোধিতাও স্পষ্ট তাঁর চিঠিতে। আদতে এই ধরনের একমাত্রিক পরিচিতি সত্তার নির্মাণ প্রক্রিয়ার দরুনই মৃত্যু হচ্ছে অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার। অনেক ভাষা আবার লুপ্তির পথে। আর তাই সেই পরিণতি জেনেই যে তামিলনাড়ু যে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে ও তুলছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি।
তবে, তাঁর কথাকে তিনি শুধু তামিলনাড়ুর মধ্যে সীমায়িত করেননি। অন্যান্য প্রদেশের নাগরিককে সম্বোধনে জুড়ে দিয়েই তিনি যে ভাষা-মানচিত্র নির্মাণ করেছেন এই ছোট্ট খোলা চিঠিতে, তা এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকই বটে। কেননা তামিলনাড়ুর এই ভাষাগত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ইতিহাস প্রাচীন। সেই ইতিহাসের সূত্র ধরেই তিনি যেন ভাষার আগ্রাসন ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের সমীকরণটিকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছেন।
:আরও শুনুন:
ভারত নয়, তবুও থাকেন ভারতীয়েরা… এই দেশটির সরকারি ভাষাও হিন্দি
এ কি শুধু একজন মুখ্যমন্ত্রীর কথা? দক্ষিণের রাজনীতির আঁতের কথাটা খেয়াল করলে এই মন্তব্যের অন্য সারবত্তা খুঁজে পাওয়া যায়। দক্ষিণের রাজ্যগুলো যে নানাদিক থেকে অনেকটাই উন্নত, এ দাবি দীর্ঘদিনের। বাস্তবিক পরিসংখ্যানও অনেক সময় সেই দাবিকে সমর্থন করে। যদিও দক্ষিণের মানুষের আক্ষেপ যে, সাফল্যই তাঁদের কাছে শাস্তির খাঁড়া হয়ে নেমেছে। উত্তর বনাম দক্ষিণের দ্বন্দ্বে বারবার দক্ষিণকে খানিকটা দূরেই সরিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে লোকসভা সিটের ডিলিমিটেশনের প্রসঙ্গও আছে। দক্ষিণের রাজনৈতিক সচেতন মানুষের বক্তব্য, ভারতের ভবিষ্যৎ কি তাহলে তাদের হাতেই নির্ধারিত হবে, যারা দক্ষিণের মত এতটা এগিয়ে নেই! এটুকু দক্ষিণের নিজস্ব বক্তব্য। সেই বক্তব্যকে অন্য প্রদেশের মানুষের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে আরও প্রসারিত করেছেন স্ট্যালিন। এবং সেখানে অবধারিত ভাবে চলে এসেছে ভাষার রাজনীতি। স্ট্যালিন জানেন, ভাষার রাজনীতির শিকড় ছড়িয়ে আছে সংস্কৃতির গভীরে। যে আগ্রাসনের রাজনীতির বিপক্ষে তাঁর অবস্থান, সেখানে পাখির চোখ হতে পারে এই ভাষাই।
ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেয়। ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার জায়গা থেকেই গড়ে উঠেছিল একদা পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন। উর্দু হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবে বিরোধিতার স্বর হয়েছিল তীব্র। আদতে তা বাঙালি জাতিসত্তাকেই এককাট্টা করে তুলেছিল। যে পথ বেয়ে এল মুক্তিযুদ্ধ। পরিশেষে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। ইতিহাস তারপর এগিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও এখন তুমুল বদল। কিন্তু ভাষা যে জাতিসত্তা ও রাজনৈতিক পরিচয়ে মানুষকে বেঁধে ফেলে, সেখানে আগ্রাসনের সব অস্ত্রই কার্যত ভোঁতা হয়ে যায়। অতএব সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে জাতীয় শিক্ষা নীতির ভাষা-প্রস্তাব হোক বা লোকসভার আসনের ডিলিমিটেশন, যা কিনা আগ্রাসনের সূচক হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই, তার একেবারে গোড়ার প্রতিরোধ হিসাবে সেই ভাষাসূত্রে জাতিসত্তা নির্মাণের দিকেই ঝুঁকেছেন স্ট্যালিন। আর দক্ষিণের এই প্রতিরোধ যে এক রাজনৈতিক অবস্থান, অন্যান্য প্রদেশের নাগরিকদের খোলা চিঠিতে জড়িয়ে নিয়ে তা তিনি আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
:আরও শুনুন:
হিন্দি ভাষার প্রসার হোক বিশ্বব্যাপী, রাষ্ট্রসংঘকে ৮ কোটির বেশি অনুদান ভারতের
অতএব এ চিঠির সার কথা, ভাষার আগ্রাসন আদতে রাজনৈতিক আগ্রাসনই। ভাষার প্রতিরোধও তাই রাজনৈতিক প্রতিরোধ। যথার্থ লক্ষ্যভেদের দরুনই এর পালটা দিতে হয়েছে বিজেপিকে। কিন্তু হিপোক্রেসি কটাক্ষে কি তা সফল হবে? যেভাবে এই চিঠি সাড়া ফেলেছে গোটা দেশে, তাতে যেন স্পষ্টই হচ্ছে, চোখা আক্রমণের মুখে আদতে ঢোঁক গিলতেই বাধ্য হচ্ছে বিজেপি শিবির।