স্ট্রোক কিংবা দুর্ঘটনা, অনেক সময়ই কেড়ে নেয় স্বাভাবিক জীবন। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানাতেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হয় অনেককে। এ যে কতখানি যন্ত্রণার, তা ভুক্তোভোগী মাত্রই জানেন। তবে সেই যন্ত্রণা থেকেই এবার মুক্তির পথ খুঁজে বের করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। ইতিমধ্যেই তাঁদের উদ্ভাবিত পদ্ধতির সফল প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে বেশ কয়েক জন রোগীর উপরে। কী সেই উপায়, আসুন, শুনে নিই।
বছর পাঁচেক আগের কথা। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় চলাফেরার শক্তি হারিয়েছিলেন এক যুবক। কোমরের পর থেকে শরীরের নিম্নাংশ অসাড়। দুর্ঘটনায় তাঁর মেরুদণ্ড মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যার ফলে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন ওই যুবক। স্বাভাবিক চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করে ফল বিশেষ কিছু মেলেনি। শেষমেশ চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্ত নেন অস্ত্রোপচারের। তবে সাধারণ ছিল না সেই অস্ত্রোপচার। ব্যতিক্রমী তো বটেই, বিরলও বলা যায়। এক্ষেত্রে, বিজ্ঞানীরা একধরনের বিশেষ ‘ইলেকট্রোড’ যুবকের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন, যা মেরুদণ্ডের কাজ করে দিতে পারে। এর মাধ্যমে স্নায়ুগুলিকে সক্রিয় করে তোলা যায়, এবং তার ফলস্বরূপ মাংশপেশিগুলিও আবার সচল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ মেরুদণ্ড যে কাজগুলি না করতে প্যারার দরুণ পক্ষাঘাত, সেই কাজগুলি করানোরই বিকল্প ব্যবস্থা করে এই বিশেষ যন্ত্রাংশ। পেশিগুলি যে কাজে ব্যবহৃত হয় – অর্থাৎ হাঁটাচলা ইত্যাদি – তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা বিজ্ঞানীরা করেছিলেন কৃত্রিম ভাবেই।
আরও শুনুন: চোখ দেখলেই এবার ধরা পড়বে হার্টের সমস্যা, কোন উপায়ের খোঁজ দিলেন বিজ্ঞানীরা?
এই অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে ওঠেন মাইকেল রকক্যাতি নামে ওই যুবক। আশ্চর্যজনক ভাবে ফিরে পান হাঁটাচলার স্বাভাবিক শক্তি। প্রত্যাশিত ভাবেই তিনি খুশি। এই অস্ত্রোপচার তাঁর কাছে উপহারের থেকে কম কিছু নয়। হাঁটা, চলা, সিঁড়িতে ওঠা- সবকিছুই এখন একা একা করতে পারছেন, স্বাধীনভাবে। এই কিছুদিন আগে যা তিনি কল্পনাও করতে পারতেন না। মাইকেলের সুস্থতা অবাক করে দিয়েছে চিকিৎসকেদেরও। জ্যাকলিন ব্লক নামে যে স্নায়ুচিকিৎসক মাইকেলের অস্ত্রোপচার করেছেন, তিনিও তাজ্জব হয়ে গিয়েছেন মাইকেলকে দেখে। পরে মাইকেলের পাশাপাশি আরও দু-জন রোগীর উপরে প্রয়োগ করা হয়েছে নতুন এই চিকিৎসা পদ্ধতি, যা সফলও হয়েছে। হাঁটা-চলা, বাইক চালানো, সাঁতার কাটার মতো অনেক কাজ করতেই সক্ষম হয়েছেন তাঁরা।
সম্প্রতি এই গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে নেচার মেডিসিন জার্নালে। পক্ষাঘাতগ্রস্তদের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি যুগান্তকারী বলেই দাবি করা হয়েছে। গবেষণার নেপথ্যে আছেন একদল সুইস বিজ্ঞানী। তাঁদের দাবি, যাঁদের উপরে এই পরীক্ষাটি করা হয়েছে, তাঁদের সকলেরই বয়স ২৯ থেকে ৪১ বছরের মধ্যে। তাঁদের প্রত্যেকের মেরুদণ্ডেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ওই বিশেষ যন্ত্রাংশটি। এবং তাঁরা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এখনও পর্যন্ত মোট ৯ জনের উপরে এই চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে, তাঁরা ফের চলাফেরার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছেন। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক গ্রেগর কোর্টিন। তিনি জানান, এই চিকিৎসা কিন্তু কোনও ভাবেই আঘাতপ্রাপ্ত মেরুদণ্ডকে সারিয়ে তুলবে না। তবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষকে স্বাধীন জীবনে ফেরাতে সাহায্য করবে এই চিকিৎসা।
আরও শুনুন: প্রায়ই প্যারাসিটামল খান! কতটা বাড়তে পারে হৃদরোগের সম্ভাবনা? জানালেন গবেষকরা
তবে এখনও বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষা সফল হলেও এই যন্ত্র নিয়ে আরও কাজ বাকি বলেই মত তাঁদের। রোজকার জীবনযাপনের পক্ষে এই যন্ত্রাংশের ব্যবহার এখনও বেশ কঠিন। এই গবেষণায় প্রচুর সাহায্য করেছেন ইংল্যান্ডের শিফিল্ডের নর্দার্ন জেলারেল হসপিটালের চিকিৎসক ড. রাম হরিহরণ। তিনি জানান, এমন কাজ এর আগে চিকিৎসাবিজ্ঞানে কখনও হয়নি। আরও ট্রায়ালের প্রয়োজন রয়েছে। তার পরেই এ ব্যাপারটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে সত্যিই যদি এই যন্ত্র কাজ দেয়, তবে তা পক্ষাঘাতের চিকিৎসায় একটা নতুন দরজা খুলে দেবে বলেই বিশ্বাস বিশেষজ্ঞদের।