মানবতা কি তবে শেষমেশ হেরেই যায়! এই সন্ধিগ্ধ এলোমেলো মুহূর্তের সামনে এসে দাঁড়ান একজন নজাকত আহমেদ শাহ। বছর আঠাশের কাশ্মিরী যুবক। প্রাণ বাজি রেখে যিনি প্রাণ বাঁচিয়েছেন পর্যটকদের। সেটাই তাঁর ধর্ম। সন্ত্রাসের ধর্ম হতে পারে, তবে পর্যটকের ধর্মপরিচয় নজাকতের কাছে ধর্তব্য হতে পারে না, হয়ওনি।
মানবতা কি কোনও ভাবেই হিংসা মুছে ফেলতে পারে না? আর কত! আর কতবার পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে স্বাভাবিক মানবধর্মকে! প্রতিবার সন্ত্রাস হামলার (Pahalgam Terror Attack) পর এ-প্রশ্ন বিদ্ধ করে সাধারাণ একজন মানুষকে- তা তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন! সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী ও ধর্মান্ধ মানুষের মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা পৃথিবী বোঝে। হয়তো মানেও। তবু যেন ঝড় উঠলে দুয়ার ভাঙে। বিদ্বেষের সরীসৃপ ছড়িয়ে পড়ে অন্তরমহলে। চেনা পৃথিবীই তখন বিষ-জর্জর। পহেলগাঁওতে সন্ত্রাস হামলার (Pahalgam Terror Attack) পর থেকেও একই যন্ত্রণা। একই রক্তক্ষরণ। ফলত সন্দেহ হয় যে, মানবতা কি তবে শেষমেশ হেরেই যায়!
আর সেই সন্ধিগ্ধ এলোমেলো মুহূর্তের সামনে এসে দাঁড়ান একজন নজাকত আহমেদ শাহ। বছর আঠাশের কাশ্মিরী যুবক (Kashmiri guide Nazakat)। প্রাণ বাজি রেখে যিনি প্রাণ বাঁচিয়েছেন পর্যটকদের। সেটাই তাঁর ধর্ম। সন্ত্রাসের ধর্ম হতে পারে, তবে পর্যটকের ধর্মপরিচয় নজাকতের কাছে ধর্তব্য হতে পারে না, হয়ওনি। আর সেই প্রাণ বাঁচানোর ঋণ স্বীকার করে তাঁকে প্রকাশ্যে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি অরবিন্দ আগরওয়াল। সোশ্যাল মিডিয়াতে তিনি নিজের যা পরিচয় দিয়েছেন, সেই সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, তিনি বিজেপি কর্মী। কিন্তু তাতে কী! দিনের শেষে মানুষের যে বড়ো পরিচয় আগলে বেঁচে থাকে সভ্যতা, তাই-ই বেঁধে রেখেছে তাঁদের দুজনকে।
আরও শুনুন: ‘চলে যাবেন না…’, নেতা নয়, সাধারণ মানুষের আর্জিতেই যেন জেগে সত্যিকার কাশ্মীর
অথচ এবার সন্ত্রাস হামলার পর থেকেই (Pahalgam Terror Attack) কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকেও। প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন এই যে, কী লাভ সেই ধর্মনিরপেক্ষতার, যা ধর্মের নামে সন্ত্রাস মুছে ফলতে পারে না! সত্যি বলতে, এ এক অলাতচক্র। এ-কথা ঠিক যে, ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ ধর্মবিদ্বেষকে মোছারই লক্ষ্য নেয়। কিন্তু তা যে পুরোপুরি সফল হয়, বলা যায় না। অন্তত ভারতের ক্ষেত্রে এ প্রায় চোখে আঙুল দেওয়া সত্যি। পশ্চিমী ধাঁচের আধুনিকতা ও সেই সূত্রে যে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুশীলন শুরু হয়েছিল, তা নিশ্চিতই এমন এক বর্গের জন্ম দিয়েছে, যারা ধর্ম থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে। সেই সূত্রে ধর্মের নামে স্বার্থসিদ্ধি ও পরধর্মে বিদ্বেষও কমানো যায় বলে মনে করা হয়। তবে এই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সূত্র ধরেই আবার অন্যান্য বর্গেরও জন্ম হয়। যে-বর্গ এই ধরনের আধুনিকতাকে প্রত্যাখ্যান করে। প্রথম বর্গটিকে তারা সন্দেহের চোখেই দেখে। মনে করে যে, নিজের ধর্মের প্রতি তারা ঠিক ততটা শ্রদ্ধাশীল নয়, যতটা হওয়া উচিত। এখান থেকেই ধর্মান্ধ শ্রেণির জন্ম। ধর্মের শুদ্ধতা বাঁচাতে গিয়ে যারা কোনও নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাসকেই বিপন্ন করে তোলো। এই ধর্মান্ধ শ্রেণির কৃতকর্মই আবার প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে। যেমনটা এখন হচ্ছে। যে ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ভারত এগিয়ে গিয়েছে, তাতে এই চক্রের ফাঁস বারবারই দেশবাসীর কাছে শ্বাসরোধী হয়ে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সন্ত্রাস হামলাও আবার সেই একই পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। ফলত যে প্রশ্ন জেগে উঠেছে, তা হল, এই চক্র থেকে কি মুক্তি নেই? আশিস নন্দী এই বিন্দুতে এসে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, প্রান্তীয় মানুষের অভিজ্ঞানের প্রতি। বহু যুগ ধরে নিজের ধর্মবিশ্বাসে আস্থা রেখে, অন্যের ধর্মবিশ্বাসকে চিনে, পরস্পরের দোষ-গুণ ভালোভাবে জেনে যেভাবে মানুষ বেঁচে থাকে, সেটিই হয়তো এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর মন্ত্র।
অতএব, সবার উপরে মানুষ সত্য। বহু তত্ত্ব ও তথ্যের জাল কেটে জেগে ওঠে মানুষের নিজস্ব আলো। সে আলোয় চেনা যায় সভ্যতার মৌলিক চেহারাটিকেই। তা কি বিদ্বেষদীর্ণ! তা তো নয়। শিক্ষিত আধুনিক সমাজেই বরং ঘৃণার চাষবাস কিঞ্চিৎ বেশি। সাম্প্রদায়িক অশান্তির ইতিহাস সে কথাই বলে। এমনকী কাশ্মীর হামলার পরও (Pahalgam Terror Attack) মুসিলমদের উপর আক্রমণ, কাশ্মীরি পড়ুয়াদের উপর হামলা, এমনকী নীরাজ চোপড়ার মাকেও দু-কথা শোনানোর মতো ঘটনা তথাকথিত অভিজাত সমাজেরই অন্ধকার-দাগ। কিন্তু সন্ত্রীসদীর্ণ কাশ্মীর কি সেই দাগ বহন করছে! সেখানে বরং উলটো ছবিই। তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন সন্ত্রাসের। সাফ জানিয়েছেন, যে এই রক্তাক্ত কাশ্মীর (Pahalgam Terror Attack) তো তাঁরা চান না। তাঁরা তো পর্যটকদের প্রাণ দিয়েই ভালোবাসেন। এ শুধু মুখের কথা নয়। জঙ্গিদের থেকে পর্যটকদের বাঁচাতে প্রাণ দিয়েছেন টাট্টু ঘোড়াচালক আদিল হুসেন শাহ! এ আসলে আয়রনিই বটে। যেখানে ধর্মান্ধের নামও আদিল, আবার মানবতার পাঠ দেওয়া যুবকের নামও আদিল। বিপর্যয়ের দিনে যে মানবতাই আমাদের একমাত্র সম্বল হয়ে উঠতে পারে, তা প্রমাণ করেছেন নজাকত আহমদ শাহও। যে ১১ জন পর্যটক সেই বিপদের মুহূর্তে তাঁর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন, নিজের প্রাণ বাজি রেখেই তাঁদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন নজাকত। পরে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন অরবিন্দ, সোশ্যাল মিডিয়াতে।
এ কি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা! আসলে রাজনৈতিক সংগঠিত প্রক্রিয়া যখন ধর্মের অর্থ বদলে দেয়, বিদ্বেষকে হাতিয়ার করে স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়, তখন, সেই আবহে মনে হয়, এ আদতে বিচ্ছিন্ন ঘটনাই। বাসের হাতল ধরার আগে কোন দল জেনে নিতে চাওয়া যে বিকৃতি, সেই তথাকথিট আধুনিকতার ভিতর বসে মনে হয়, সত্যিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আসলে তা নয়। ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ও অন্যের ধর্মবিশ্বাস জেনে মানুষের বহুযুগের বেঁচে থাকার অভ্যাস আর শিক্ষাই শেষমেশ টিকে থাকে।
বহু যুদ্ধ, বহু হামলা, বহু বিদ্বেষ-ব্যবসা সত্ত্বেও, মানবতা তাই শেষ পর্যন্ত হেরে যেতে যেতেও জিতেই যায়।