ভারত-পাক অশান্তির প্রেক্ষাপটে সিনেমা তৈরি, নতুন কিছু নয়। ‘বর্ডার’, ‘হকিকত’ কিংবা ‘উরি-দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক’, জাতীয়তাবাদের আবেগে ভালোমতো ঢেউ তোলে। সিনেমার পর্দায় কিছুটা রং চড়ে ঠিকই। তবে সেসব হবহু সত্যি বলেই ভেবে নেন বহু দর্শক। সেই তালিকায় এবার জুড়তে পারে ‘অপারেশন সিঁদুর’। প্রযোজকদের আচরণে মিলছে সেই ইঙ্গিত।
‘হাউ ইজ দ্য জোশ?’
‘হাই স্যার!’
জনপ্রিয় ডায়লগ। ভীষণ চেনা। ভারত-পাক অশান্তির আবহে তা নতুন করে চর্চায় ফিরেছে। বিশেষ করে ‘অপারেশন সিঁদুর’ (Operation Sindoor) নিয়ে যাবতীয় চর্চার সঙ্গে জুড়ছে এই চেনা ডায়লগটি। কিন্তু সিনেমার এই ডায়লগ, বাস্তবে কোনও সেনানায়ক ব্যবহার করেছিলেন কি?
এ প্রশ্ন কেউ করে না। প্রয়োজনও পড়ে না। বাস্তবে যাই ঘটে থাকুক, সিনেমায় যেটা দেখানো হয়েছে সেটাই সত্যি বলে ধরে নেন বহু দর্শক। আর এখানেই একটা কথা আড়ালে চলে যায়, সিনেমা আসলে বিনোদন। তা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে হলেও ধারণা তেমন বদলায় না। স্রেফ ধরণটা বদলাতে পারে। মানে হাসির সিনেমায় বিনোদনের ধরণ আর দুঃখের সিনেমায় বিনোদনের ধরণ কখনওই এক নয়। তবে দুই ক্ষেত্রেই বিষয়টাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ করে দেখান বহু সিনেমা নির্মাতা। বোদ্ধারা বলেন, তার কারণও রয়েছে অনেক। হুবহু বাস্তব দেখালে সেই সিনেমায় ব্যবসা হয় না। তাই সিনেমায় এমন অনেক কিছুই দেখানো হয় যা বাস্তবে সম্ভব নয়। বিনোদনের স্বার্থেই সবকিছু।
এই হিসাবে যুদ্ধ নিয়ে তৈরি সিনেমাকেও কিছুটা অবাস্তব হতে হয়। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে একেবারে হুবহু সত্যি নির্মাতাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, জানলেও তা পর্দায় দেখানো সম্ভব নয়। সুতরাং কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিতেই হয়। আর সেখানেই জন্মায় ‘হাউ ইজ দ্য জোশ?’-এর মতো ডায়লগ। যা অল্পদিনেই জাতীয়তাবাদের অংশ হয়ে ওঠে। তাতে আখেরে লাভ হয় সেই নির্মাতাদের। তাঁরা আরও উৎসাহ পান, এই ধরনের সত্যি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিনেমা তৈরি করার। যুদ্ধ নিয়ে তৈরি বিভিন্ন সিনেমা সেই যুক্তির জলজ্যান্ত প্রমাণ। তবে বিষয়টা কোথাও গিয়ে প্রতিযোগিতার মতো হয়ে উঠছে। মানে কোনও একটা বিশেষ ঘটনা, মূলত যুদ্ধের সমতুল্য, তা পর্দায় দেখানোর জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করে দিচ্ছেন প্রযোজকরা। ‘অপারেশন সিঁদুরের’ (Operation Sindoor) টাইটেল রেজিস্টারের ধূম দেখেও সে কথাই স্পষ্ট হল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধের সরাসরি সম্প্রচার দেখিয়ে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়েছিল বহু সংবাদ সংস্থা। সেই ধারা এখনও চলছে। সম্প্রচারের পদ্ধতি এখন আরও উন্নত। দূর থেকেও অশান্তির পরিস্থিতি লাইভ দেখানো সম্ভব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় এইধরনের বহু ভিডিও বিশ্ব দেখেছে। কিন্তু কোনও গোপন অভিযান সরাসরি দেখানো সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট বিভাগের তরফে যেটুকু জানানো হয়, তাই সম্বল। কিন্তু যে দর্শক সরাসরি যুদ্ধ দেখছে তারা ওইটুকুতে কীভাবে সন্তুষ্ট থাকবে? আর সেখান থেকেই এই ধরনের গোপন অভিযান নিয়ে সিনেমা তৈরির চল শুরু।
সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ঘটনা অবলম্বনে তৈরি সিনেমা ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল। শুধু তাই নয়, বিগত বছগুলোতে বলিউডে এমন অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে যেখানে ভারতীয় সেনার সাফল্য উদযাপিত হয়েছে। তাতে হয়তো ভুল নেই বলেই দাবি করবেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, এই ধরনের সিনেমা দেশপ্রেমের আবেগে ঢেউ তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিছুক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রসঙ্গও জুড়ছে। অর্থাৎ সেনার সাফল্য সিনেমায় দেখানোর সময় প্রচ্ছন্নভাবে প্রচার করা হচ্ছে শাসকদলের। তা নিয়ে সরব হন বিরোধীরা। জাতীয়তাবাদের আবেগের সামনে সেসব বিরোধ পাত্তা পায় না। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। এইসব সিনেমা দেখেই যেন দর্শকদের মনে হতে শুরু করে, গোপন অভিযান আসলেই ভীষণ সিনেম্যাটিক। জ্বালাময়ী ডায়লগ থাকবে সবক্ষেত্রে, বিশেষ কায়দায় বেঁচে ফিরে আসবেন ক্যাপ্টেন তথা সিনেমার নায়ক, তাঁর প্রেম হবে, বিয়ে হবে, আরও কতকিছু।
তাই নতুন কোনও সেনা অভিযান হলেই সেটার উপর তৈরি সিনেমা দেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন অনেকে। প্রযোজকরাও তাই এতটুকু সময় নষ্ট না করার ফুরসত পান না। কেন্দ্রের নিয়মে এই ধরনের সিনেমা তৈরির আগে অনুমতি নিতে হয়। সরাসরি কেন্দ্রের দেওয়া নাম ব্যবহার করা যায় না। বদলে কিছু নতুন নামের প্রস্তাব পাঠাতে হবে। অপারেশন সিঁদুরের (Operation Sindoor) ক্ষেত্রে নাকি ৪০-৪৫ টি নামের প্রস্তাব এসেছে। তালিকায় রয়েছে, ‘সিঁদুর এক বদলা’, ‘সিঁদুর কা ফর্জ’, ‘সিঁদুর এক জংগ’ ইত্যাদি বিভিন্ন নাম।
আসলে যা কিছু সাধারণের পক্ষে জানা অসম্ভব, তা দেখার আগ্রহ থাকে সকলের। যুদ্ধের ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। যতই অস্থির পরিস্থিতি হোক, রক্ত থাকুক, হিংসা থাকুক, সেসব বিনোদনের মতোই উপভোগ করেন অনেকে। কারণ সিনেমায় দেখানো যুদ্ধে সবকিছু গল্পের মতো। ‘বর্ডার’, ‘উরি’ কিংবা এই ধরনের আরও অনেক সিনেমা তার উদাহরণ। বাস্তবে যাই ঘটুক, মোটের উপর কাহিনি এক রেখে, প্রচন্ড সিনেম্যাটিক মোড়কে উপস্থাপন করা হয় দর্শকদের সামনে। তাই অপারেশনের সিঁদুরের (Operation Sindoor) মতো এত বড় অভিযানকেও সিনেমায় পর্দায় আনতে ব্যস্ত প্রযোজকরা।
জনপ্রিয় চিত্র পরিচালক অশোক পণ্ডিত বিষয়টাকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখেছেন। একবার টাইটেল রেজিস্টার অন্য কারও নামে হয়ে গেলে, একই নামে সিনেমা তৈরি করা সম্ভব হবে না। আর বর্ডার বা উরির মতো সিনেমার দ্বিতীয় অনুকরণ খুব একটা জমবে না বলেই ধারণা পরিচালকদের। তাই আগেভাগে আগাম ব্যবসার পথটা সহজ করে রাখতে চাইছেন তাঁরা। তবে এই যুদ্ধকে এত সহজে বিনোদনে করে তোলার বিষয়টা ভালোভাবে নেয়নি নেটদুনিয়া। বিশেষ করে বর্তমানে দেশে যে সংঘাতের আবহ, সেখানে যুদ্ধ নিয়ে সিনেমা তৈরির হুড়োহুড়ি কাম্য নয় বলেই মনে করছেন তাঁরা।
হয়তো এই নেটদনিয়ায় উলটোসুরে গাইবে কিছুদিন পর। পরিস্থিতি কালের নিয়মে স্বাভাবিক হবেই। তখন যুদ্ধ নিইয়ে তৈরি সিনেমায় হবে আলোচনার বিষয়। উরি, বর্ডারের তালিকায় অপারেশন সিঁদুর ঢুকলে, খুব একটা অবাক কেউই হবেন না। শুধু বর্তমান পরিস্থিতিতে এই নিয়ে মাতামাতি ভুল ঠেকেছে অনেকের। বাস্তবে, বিনোদনের মোড়কে যুদ্ধ অনেকের কাছে বেশ উপভোগ্য।