“কেউ যদি বেশি খাও, খাওয়ার হিসেব নাও, কেন-না অনেক লোক ভালো করে খায় না”… নাগরিক কবিয়ালের এ কথা গোটা দেশের প্রেক্ষিতেই সত্যি। আর এই খাওয়া না-খাওয়ার খেলা চলতে থাকলে যে কী হতে পারে, সম্প্রতি তারই ইঙ্গিত মিলল এক সমীক্ষায়। একদিকে দেশজুড়ে অপুষ্টির বাড়বাড়ন্তে আশঙ্কিত গবেষকেরা, অন্যদিকে ত্রাস ছড়াচ্ছে ওবেসিটি। আর দুয়ে মিলে কেবল বিপন্নতাই বাড়ছে দেশের।
খাবার না জোটার চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে! কিন্তু অতিরিক্ত খেতে পাওয়াও বোধহয় কখনও কখনও অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। দেশের সাম্প্রতিক খাদ্য মানচিত্রের দিকে তাকালে এমন কথা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ সেখানে খাওয়া আর না-খাওয়ার পাশাপাশি সহাবস্থান। অথচ কোনও ছবিটিই দেশের জন্য স্বস্তির নয়।
সত্যি বলতে বিশ্বজুড়ে প্রত্যেক দেশেই চিন্তা বাড়াচ্ছে অপুষ্টি, দীর্ঘদিন ধরেই এ কথা জানিয়ে আসছেন গবেষকেরা। গ্লোবাল নিউট্রিশন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের অন্তত ৪৪ শতাংশ দেশের অপুষ্টির হার মাত্রা ছাড়াচ্ছে। আর সেই তালিকায় ভারত তো রয়েছেই। এ দেশে গত ৫ বছরে মারাত্মক অপুষ্টি আরও বেশি করে থাবা বসিয়েছে, ২০২২ সালেই এমনটা দাবি করেছিল এক রিপোর্ট। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যেই এই হার ছিল সবচেয়ে বেশি। দেখা যায়, ৩৬টি রাজ্যের ৩৪১টি জেলায় অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুদের মধ্যে severe acute malnutrition-এর হার বেড়েছে। মনে রাখা ভালো, যে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি, তারা মিডডে মিল প্রকল্পের আওতাতেও পড়ছে না। সব মিলিয়ে অবস্থাটা রীতিমতো আশঙ্কা জাগানোর মতোই। সময় পালটালেও সে অবস্থা বিশেষ বদলায়নি। কিন্তু এবার তার মধ্যেই নয়া আশঙ্কার খবর শোনাল আরেক সমীক্ষা। বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেটের এক গবেষণা জানাচ্ছে, এ দেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওবেসিটির হার। এতটাই যে, তাকে বিজ্ঞানীরা প্রায় মহামারির সঙ্গে তুলনা করছেন।
আরও শুনুন:
বাবার পদবি ব্যবহার করতে লাগবে স্বামীর অনুমতি! এ দেশের মেয়েদের বড় হতে নেই?
দেখা গিয়েছে, ১৯৯০ সালে দেশে মোট ৪ লাখ শিশুর ওবেসিটি ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কমা দূরে থাক, উলটে লাফিয়ে বেড়েছে। গত ৩২ বছরে সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে ১২.৫ মিলিয়নের কোঠায়। অর্থাৎ গোটা দেশে ১ কোটি আড়াই লাখ শিশু ওবেসিটির কবলে। এর মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা ৭৩ লাখ। মেয়েদের সংখ্যা ৫২ লাখ। আর শুধু খুদেরাই নয়, এই মহামারি থেকে নিস্তার নেই বড়দেরও। যতই ডায়েট নিয়ে মাতামাতি চলুক না কেন, সমীক্ষা জানাচ্ছে, পুরুষদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজনের প্রবণতা বেড়েছে প্রায় ২৩ গুণ। ২০২২ সাল পর্যন্ত নেওয়া তথ্য জানাচ্ছে, আড়াই কোটির বেশি পুরুষ ও প্রায় সাড়ে চার কোটি মহিলা ওবেসিটির শিকার।
আরও শুনুন:
জিডিপি বৃদ্ধির হারে আশার আলো, কিন্তু তার নেপথ্যে কি কর্মসংস্থানের উন্নতি দেখা গেল?
তবে কথা হল, এই ওবেসিটির জন্যেও এক অর্থে অপুষ্টিকে দায়ী করছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, এর একটা বড় কারণ হচ্ছে, সুলভ মূল্যে পুষ্টিকর খাবার না মেলা। হ্যাঁ, ওবেসিটিকে কেবল ‘বড়লোকের রোগ’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা। বদলে বলছেন, এ দেশে কৃত্রিম খাবার, জাঙ্ক ফুড পুষ্টিকর খাবারের চেয়ে সস্তা হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যাঁরা শহরের বাসিন্দা, তাঁদের অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকলেও, ফল-সব্জির বদলে ওই খাবার কেনা তাঁদের পক্ষে সুবিধাজনক। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের তথ্য বলছে, গ্রামের তুলনায় শহরেই ওবেসিটির হারও বেশি। সব মিলিয়ে অপুষ্টিকেও এখন আর একমাত্রিক ভাবে দেখার উপায় নেই। আর তার ঠেলাতেই ক্রমশ বিপন্নতা বাড়ছে গোটা দেশেরই।