শান্তির মাস রমজানেও গুলির শব্দ শুনছে গাজা। উপবাসের জন্য আর রোজার প্রয়োজন নেই, খিদে আর অনাহারই এখন তার দিনলিপি। সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মায়ের কবরের পাশে বসেই রমজান শুরু হয়েছে এই যুবকের।
উৎসবের দিনে ঘরে ফেরার কথা মনে হয়। পরিবারের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকার ডাক পাঠায় সেইসব আলোর দিন। কিন্তু গাজার আকাশে এখন আলো ছিটকে নেমে আসে লেজার ওয়েপন। যার আঘাতে যে কোনও সময় মুছে যায় গোটা পরিবারটাই। যে বাস্তবের মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন এই যুবক, ইব্রাহিম হাসৌনা। রমজানের দিনে তাঁর জন্য আর হাত বাড়িয়ে নেই কোনও কাছের মানুষ। যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে তাঁদের সকলকেই। পরিবারের মানুষদের কবরের পাশে বসেই এবার রমজান শুরু হয়েছে তাঁর। সেই ধু-ধু শূন্যতায় তাঁকে ঘিরে আছে কেবল মৃত মায়ের গলার স্বর। মৃত্যুর আগে ছেলেকে শেষ যে ভয়েসমেল পাঠিয়েছিলেন তাঁর মা, সেই স্বরটুকুই ছুঁয়ে আছেন ইব্রাহিম। সমস্ত শূন্যতার পর এটুকুই তাঁর সম্বল। রমজানের দিনে এটুকুই হয়তো তাঁর উপবাস ভাঙার ইফতার।
আরও শুনুন:
স্রেফ সংখ্যা নয়, ওরাও মানুষ… সন্তানের নাম শরীরে লিখে বার্তা গাজার অভিভাবকদের
লাগাতার বোমাবর্ষণ, রকেট হামলায় গাজার শয়ে শয়ে মানুষ মুহূর্তেই নাম হারিয়ে এক-একটা সংখ্যা হয়ে গিয়েছেন। রাজনীতি আর রাষ্ট্রনীতির যুদ্ধে তাঁদের সব অস্তিত্ব মিথ্যে হয়ে গিয়েছে রোজ। আর মহিলাদের জীবনে তো এমনিই নাম হারিয়ে যায় যখনতখন। এই যেমন, এই নিহত মহিলার আসল নামও যে কী ছিল তা বলা মুশকিল। উম করম নামেই তিনি পরিচিত, অর্থাৎ করমের মা। বড় ছেলে করমের নাম জুড়েই তাঁর অস্তিত্ব। আর তাঁর জীবনের কেন্দ্রেও ছিল কেবল সন্তানরাই। ইব্রাহিম বলছেন, দু-তিন ঘণ্টার জন্য বাইরে গেলেও মায়ের ফোন আসত। মায়ের যেন মনেই থাকত না যে আমার বয়স ৩০ হয়ে গিয়েছে। এমনকি শেষ ভয়েসমেলটিও এসেছিল সেই খোঁজ নেওয়ার উদ্দেশ্যেই। ছেলে ফোন ধরছে না, সে ঠিক আছে কি না, এটুকু জেনেই নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন মা। সেদিন ইব্রাহিম জানতেন না, এমন প্রশ্ন আর আসবে না তাঁর দিকে। সেসময় যে খোঁজ নেওয়ার অভ্যাস কখনও কখনও বিরক্তই করত, এখন সেই অভ্যাসকেই খুঁজে ফিরছেন তিনি।
আরও শুনুন:
জল পর্যন্ত নেই, মুঠো মুঠো ওষুধ খেয়ে পিরিয়ডস পিছোতে মরিয়া গাজার মহিলারা
এবারের রমজানে আর কোল পেতে বসে নেই মা। নেই পরিবারের ওমও। পরিবারের সঙ্গ পাওয়ার জন্য বাড়িতে নয়, কবরখানায় যেতে হয়েছে ইব্রাহিমকে। সেখানে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে মা, বাবা, ছোট ভাই মহম্মদ আর বড় ভাই করম ও তাঁর পরিবারের সমাধি। ইফতারের সময় আর সকলের কলরব নেই, খুনসুটি নেই। নেই সুস্বাদু খাবারের সুগন্ধও। যুদ্ধের গাজায় এখন বারুদ আর খিদের গন্ধই একমাত্র সত্যি। এইসব না-থাকার মধ্যে বসে বোধহয় আর ক্ষোভও নেই ইব্রাহিমের। যুদ্ধের হুংকারে যেখানে মানুষের বেঁচে থাকাটুকুই বড় সংকটে, সেখানে মানুষ বোধহয় বুঝেই নেন যে ঈশ্বরের কাছেও তাঁদের অসহায়তার কোনও উত্তর মেলা ভার। শান্তি নয়, সেই অসহায়তার মাস হয়েই এবার রমজান এসেছে যুদ্ধের শহরে।