বর্তমানে দেশের বড় পরিসরে মার্কসবাদী ও সেকুলার শব্দ দুটি প্রায় তামাশার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু লোকসভার মধ্যে ফিরে এলেন সেই কার্ল মার্কসই। আর তাঁকে ফেরানোর কৃতিত্ব সেই মোদিরই। কীভাবে? শুনে নেওয়া যাক।
দেশজুড়ে লোকসভা ভোটের গরম হাওয়ার মধ্যে হাজির খোদ কার্ল মার্কস। না, কোনও বাম দল বা নেতার হাত ধরে নয়। দেখা যাচ্ছে, আসলে মার্কসকে ফেরালেন সেই মোদিই। কিন্তু দুই পক্ষের চিন্তা চেতনার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, তা তো অজানা নয়। তাহলে এ ঘটনা ঘটল কেমন করে?
আরও শুনুন:
মঙ্গল-অমঙ্গলসূত্র! দুর্নীতিকে দূরে ঠেলে ভোট যেন সেই ‘ধর্ম’যুদ্ধ
আসলে সম্প্রতিই সম্পত্তির পুনর্বণ্টন প্রসঙ্গে কংগ্রেসকে তোপ দেগেছিলেন মোদি। আর সেই আক্রমণ শানাতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন, তাতে সরগরম গোটা দেশ। আর এই আবহেই একই ইস্যুতে মুখ খুলল দেশের শীর্ষ আদালতও। যা কিছু ব্যক্তিগত, তা কি বরাবরই ব্যক্তির অধিকারেই থাকবে? নাকি সেই সম্পত্তিতে সরকারেরও অধিকার থাকতে পারে? যাতে জনসাধারণের কল্যাণের কথা ভেবে তা কখনও পুনর্বণ্টন করাও যায়? সম্পত্তি পুনর্বণ্টন নিয়ে মোদি-মন্তব্যের প্রেক্ষিতেই উসকে উঠেছে এমন প্রশ্ন। সংবিধানের ৩৯ সংখ্যক আর্টিকল-এর যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বিচারপতি ভিআর কৃষ্ণা, ১৯৭৭ সালের সেই পর্যবেক্ষণের কথাও মনে করিয়েছে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় সহ ৯ বিচারপতির বেঞ্চ। মনে করা হচ্ছে, সম্পত্তির পুনর্বণ্টন নিয়ে মোদির বক্তব্যে যে মনোভাবের ইশারা মিলছে, তা আদতে শীর্ষ আদালতের ওই পর্যবেক্ষণকে মানছে না। কারণ সেই পুরনো রায়েও বলা হয়েছিল, প্রয়োজনে এবং পরিস্থিতি বুঝে ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সমাজের সুবিধার্থে ব্যবহার করা যেতে পারে। সুতরাং যদি এমন কথা বলা হয় যে, কোনও পরিস্থিতিতেই জনকল্যাণের জন্যও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে সরকার হাত দিতে পারবে না এবং সেই সম্পত্তিকে সমাজের সঞ্চয় হিসেবে দেখতে পারবে না, তবে এই ধারণাকে সরকারের জন্যই বিপজ্জনক বলে মনে করছে সুপ্রিম কোর্ট। যে বক্তব্যে আসলে মার্কসবাদী আদর্শের ছাপই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। কোনও একজন ব্যক্তিমানুষের বদলে সমগ্র সমাজের কল্যাণের কথা ভাবা, আর সেই কল্যাণের চিন্তা থেকেই সম্পদের সমবণ্টনের নীতি, এই ধারণার সঙ্গেই মার্কসবাদকে মিলিয়ে দেখছেন তাঁরা। এমনিতে দেশের রাজনীতিতে মার্কসের প্রভাব নতুন নয়। বাম রাজনীতির ভিত দাঁড়িয়ে ছিল মার্কসবাদের উপরেই। কিন্তু সেই রাজনীতির পালটা দিতে গিয়ে সেই নীতি-আদর্শের উপরে লাগাতার আক্রমণ শানানো হয়েছে। দেশে গেরুয়া শিবিরের প্রভাব যত বেড়েছে, ততই বৃহত্তর পরিসরে মার্কসবাদী ও সেকুলার শব্দ দুটি প্রায় তামাশার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে গোটা দেশকে তার সমস্ত বৈচিত্র্য নাকচ করে একরঙা সুতোয় বাঁধার কথা বলছে বিজেপি। অন্যদিকে শ্রম ও সম্পত্তির বণ্টন নিয়ে মার্কসের ভাবনায় যে সাম্যের কথা বলা হয়েছে, আবার ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যেও সব ধর্মকে সমান চোখে দেখার যে বার্তা রয়েছে, তা ওই একমাত্রিকতার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে। সে কারণেই মার্কসবাদী চিন্তাকে নাকচ করাই, এমনকি এই সাম্যের ভাবনাকে হিন্দুত্বের পরিপন্থী বা মুসলিম তোষণ বলে দাগিয়ে দেওয়াও বিজেপির স্বভাব। সেখানে দেখা যাচ্ছে, মোদি না চাইলেও তাঁর মন্তব্যের সূত্র ধরেই ভারতের রাজনৈতিক পরিসরে ফের ঢুকে পড়লেন কার্ল মার্কস।
আরও শুনুন:
মুখে কুলুপ, ভোট চলুক! নীরবতাই হাতিয়ার মুসলিমদের, পর্যবেক্ষণ বিশেষজ্ঞদের
সম্প্রতি হায়দরাবাদে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে কোন শ্রেণির হাতে কত সম্পদ আছে তা সমীক্ষা করে দেখবে। সত্যি বলতে, সম্পদের বৈষম্য ঘোচাতে চাইলে এহেন সমীক্ষা করার কথা উঠতেই পারে। এর মধ্যে রাহুল-ঘনিষ্ঠ কংগ্রেস নেতা স্যাম পিত্রোদাও সম্পদের পুনর্বণ্টনের কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে ভারতেও আমেরিকার মতো উত্তরাধিকার আইন কার্যকর করার প্রস্তাব করেন ইন্ডিয়ান ওভারসিস কংগ্রেসের চেয়ারম্যান পিত্রোদা। আমেরিকার ওই আইন অনুযায়ী, বাবা-মা মারা যাওয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে সেই সম্পত্তির পুরোটা সন্তান পান না। তার একটা অংশ যায় সরকারি খাতে, দেশের কাজে। কিন্তু কংগ্রেস শিবিরের এই বক্তব্যকে হাতিয়ার করেই মোদির কটাক্ষ, জীবিত অবস্থায় তো বটেই, মৃত্যুর পরেও জনগণের সম্পত্তি লুট করতে চায় কংগ্রেস। তাঁর দাবি, ‘‘অতীতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, দেশের সম্পদে সর্বাগ্রে অধিকার মুসলিমদের। সেই কারণেই সমীক্ষা করার পরিকল্পনা নিয়েছে কংগ্রেস। যাতে দেশবাসীর কষ্টার্জিত অর্থ মুসলিম ও অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া যায়।’’ অথচ পরিশ্রম করে অর্জিত সম্পদের বদলে কেউ কেবল জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদেই ধনী হবে, আরেকদিকে বিপুলসংখ্যক মানুষ পড়ে থাকবে কিচ্ছু না-পাওয়ার দলে, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এমন বিরাট বৈষম্যের প্রতিবাদ করা হয়েছে বারবার। রাজনীতির কথা যদি ছেড়েও দিই, মানুষের গানও বলেছে, “কেউ যদি বেশি খাও, খাবার হিসেব নাও, কেননা অনেক লোক ভালো করে খায় না”। কিন্তু সম্পদের পুনর্বণ্টন দূরে থাক, সমীক্ষা করে এই বৈষম্যকে চিহ্নিত করার প্রসঙ্গেও বিরোধিতাই শোনা গেল মোদির মুখে। একে পারিবারিক সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত বলেই বারবার তোপ দাগছেন তিনি। কিন্তু তাঁর কথার বিরোধিতার সূত্রেই যেসব পালটা বক্তব্য উঠে আসছে, সেখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে সাম্যের ভাবনাই। সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণেও জারি রইল ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সেই সমতার দৃষ্টি। আর নাম উঠুক বা না উঠুক, সেখানে হাজির রইলেন মার্কসও।