১৯১৪ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে যে ভারতীয় সেনারা শহিদ হন, তাঁদের তর্পণ করে এই স্মারক। আর সেই ওয়ার মেমোরিয়াল-এর সামনেই কার্যত অর্ধনগ্ন শরীরে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে নাচের ভিডিও করেছেন এই তরুণী। তা নিয়ে যতই বিতর্ক হোক না কেন, ইতিমধ্যেই কিন্তু ৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ সে ভিডিও দেখে ফেলেছেন। আর প্রশ্নটা এখানেই। এই ভিউ বাড়ানোর দৌড়েই কি স্বাভাবিক ভব্যতা, বিচার বিবেচনাও পিছিয়ে পড়ছে কোথাও?
গায়ে কেবল তোয়ালে। অন্য কোনও পোশাক নেই পরনে। পায়ে চপ্পল। আর এভাবেই উদ্দাম নৃত্য তরুণীর। তবে বাথরুমে নয়, নয় বেডরুমেও, প্রকাশ্য রাজপথেই নাচ জুড়েছেন তিনি। হ্যাঁ, সম্প্রতি রাজধানী দিল্লিতেই এহেন কাণ্ড ঘটেছে। ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’ ছবিতে কাজলের তোয়ালে পরে নাচের অনুকরণেই নেচে উঠেছেন ওই তরুণী। শরীরে শুধুমাত্র একটি তোয়ালে জড়িয়ে ইন্ডিয়া গেটের সামনে নাচের ভিডিও করেছেন তিনি, আর সেই ভিডিও পোস্ট করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই ভিডিও ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই উসকে উঠেছে বিতর্ক। এহেন ভিডিও শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করছে বলেই মত নেটিজেনদের একাংশের।
ওই তরুণী যেখানে এহেন ভিডিও করেছেন, সেই ইন্ডিয়া গেট তৈরি করা হয়েছিল শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশে সম্মান জানিয়ে। ১৯১৪ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে যে ভারতীয় সেনারা শহিদ হন, তাঁদের তর্পণ করে এই স্মারক। আর সেই ওয়ার মেমোরিয়াল-এর সামনেই কার্যত অর্ধনগ্ন শরীরে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে নাচের ভিডিও করেছেন এই তরুণী। তা নিয়ে যতই বিতর্ক হোক না কেন, ইতিমধ্যেই কিন্তু ৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ সে ভিডিও দেখে ফেলেছেন।
আর প্রশ্নটা এখানেই। এই ভিউ বাড়ানোর দৌড়েই কি স্বাভাবিক ভব্যতা, বিচার বিবেচনাও পিছিয়ে পড়ছে কোথাও? এর আগেও দুর্গাপূজা মণ্ডপে খাটো পোশাক পরে গিয়ে চর্চায় উঠে এসেছিলেন এই তরুণী, এবারেও তাঁর পোশাক নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। কিন্তু সে কথায় যাচ্ছি না। পোশাকের চেয়েও এখানে বেশি জরুরি প্রশ্ন হল, স্থান নির্বাচন। কে কোথায় কোন পোশাক পরবেন তা নিয়ে নীতিপুলিশিকে বাদ রেখেই বলা যায়, কে কোথায় কী আচরণ করবেন তার প্রাথমিক কিছু বিধি আছে বইকি। যে সেনারা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, সেই শহিদদের স্মরণে যে শোকস্তম্ভ, যুদ্ধ-প্রাণহানি-মৃত্যুর স্মৃতি সেখানে বিষাদ টেনে আনে। পুরনো ইতিহাসের পাতা মানুষকে তার শিকড় মনে করিয়ে দিয়ে দু’দণ্ড থমকে দাঁড়াতে বলে। পোশাক অশালীন হোক বা না হোক, অন্যদের জন্য আত্মবলিদান দেওয়া মানুষদের স্মৃতির সামনে দাঁড়িয়ে আত্মকেন্দ্রিকতার উৎকট প্রদর্শনটিই আসলে অশ্লীল।
সাম্প্রতিক কালেই দেখা গিয়েছে, আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে গিয়েও নানা ভঙ্গিতে ছবি-রিল ক্যামেরাবন্দি করতেই ব্যস্ত অনেকেই। সোশ্যাল মিডিয়ার ইনফ্লুয়েন্সার হলে তো কথাই নেই। যে সেলুলার জেলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রক্তের দাগ লেগে আছে, সেই অত্যাচারের চিহ্ন ধরে রাখা কারাগারে দাঁড়িয়ে এহেন উচ্ছল আচরণকে বিসদৃশ মনে করেছেন অনেকেই। উচ্ছলতা, আনন্দ প্রকাশের স্থান তো অনেকই রয়েছে, কিন্তু চূড়ান্ত শোক বা নিরানন্দের কোনও স্থানে দাঁড়িয়েও যদি আনন্দ প্রকাশ করতে হয়, তবে বোঝা যায় যে, অন্যদের অনুভূতিকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে কেবল নিজেদের ব্যক্তি-আমিটুকু নিয়েই আমরা ভাবিত। এই সাম্প্রতিক ভিডিওটিও সে কথাই ফের মনে করিয়ে দিল।
যদিও, ‘কালচার শক’-এর আঘাতে সরগরম যে সোশাল মিডিয়া, সেই সোশাল মিডিয়াই আবার এই ভাইরাল কালচার-এর জনক, তার পৃষ্ঠপোষকও বটে। যাঁরা এ ঘটনার সমালোচনায় মুখর, এই কনটেন্টের ভোক্তাও কি আসলে তাঁরাই নন? রিল বানানোর নেপথ্যে যে ভিউয়ের তাড়না আছে, তাকে অস্বীকার করার জো নেই। ভিউয়ের বাড়বাড়ন্ত থেকে যে এই ডিজিটাল ক্রিয়েটররা আর্থিক লাভও করতে পারেন, সে কথাও জানা। আলোচ্য ভিডিওটির ভিউ-এর পরিসংখ্যান দেখেও সে কথা দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। আর এই তাড়নাই মানুষকে আগুপিছু না ভেবেই আরও ছুটতে বলছে। মানুষের মনে যে নজর কাড়ার গোপন বাসনা রয়েছে, তার দরজা খুলে দিয়েছে সোশাল মিডিয়ার এই উপাদানগুলি। যা কিছু হয়েই থাকে, তা যে আলাদা করে নজর কাড়ে না, তাও সত্যি। তাই চরম অপ্রত্যাশিত, কি নাটুকে কোনও কাণ্ড করে তবেই নজর কাড়তে হবে, এমনটাই অভ্যাস করিয়ে দিয়েছে সোশাল মিডিয়া। সেখানে যদি কোনও কিছু নিয়ে ‘শক’ লাগারই থাকে, তবে দেশের সংস্কৃতি নয়, এই ভাইরাল সংস্কৃতি নিয়েই বোধহয় ভাবনা জরুরি।