“অনাহারে নাহি খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ”- মগজধোলাই যন্ত্রে ঢুকিয়ে কেউ যেন এমনই কোনও মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে। প্রতিদিনের খাবারটুকু জোগাড় করতেই নাভিশ্বাস উঠছে দেশের অধিকাংশ মানুষের। অথচ সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও দেশের উন্নতির পরিসংখ্যান দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতৃত্বরা। খোদ প্রধানমন্ত্রী যেখানে গরিবের সেবা এবং কল্যাণকেই অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘোষণা করছেন, সেখানে বাস্তবের ছবি কার্যত উলটো কথাই বলছে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
মন্দির-মসজিদ বিতর্কে উত্তাল গোটা দেশ। বিতর্কিত মন্তব্যের জের, একাধিক মামলা, সওয়াল জবাব, সব মিলিয়ে সরগরম অবস্থা। কিন্তু ধর্ম নিয়ে এত তরজার আড়ালে ঠিক কেমন আছে দেশের আমজনতা? সে প্রশ্নেরই যেন উত্তর দিল এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর করা ওই সমীক্ষার রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, দৈনন্দিন যতটুকু খাবার প্রয়োজন, সেটুকুও জোগাড় করে উঠতে পারছেন না দেশের প্রায় ৭১ শতাংশ মানুষ। যথাযথ খাবার না পাওয়ার ফলে স্রেফ অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েন অনেকেই। আর সেই কারণেই প্রতি বছর মারা যান অন্তত ১৭ লক্ষ মানুষ। দেশের অভ্যন্তরীণ দুরবস্থার দিকেই কার্যত আঙুল তুলছে সিএসই-র এই সাম্প্রতিক সমীক্ষাটি, এমনটাই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।
আরও শুনুন: প্রচার হচ্ছে ধর্ষণের! পারফিউমের ‘আপত্তিকর’ বিজ্ঞাপনে ক্ষুব্ধ নেটিজেনরা
এখানেই শেষ নয়। বিস্তারিত গবেষণায় আরও দেখা যাচ্ছে, বিগত এক বছরের মধ্যে কনজিউমার ফুড প্রাইস ইনডেস্ক অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ঘটেছে ৩২৭ শতাংশ। এমনকি গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে এই মুদ্রাস্ফীতির হার শহরাঞ্চলের তুলনায় বেশি। দেশের অধিকাংশ মানুষ যা উপার্জন করেন, পরিমিত খাদ্য জোগাড় করার খরচ তার চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেশি। এমনটাই দাবি করেছে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। বলাই বাহুল্য, আয় ও ব্যয়ের এই গরমিল পেরিয়ে সুষম আহার জোগাড় করে ওঠা প্রায় অসম্ভব। কোনও মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় যে পরিমাণ প্রোটিনজাতীয় খাদ্য, দানাশস্য, ফল, সবুজ সবজি ইত্যাদি থাকা উচিত, তার চাহিদা মিটছে না আদৌ। আর সেই অপুষ্টিই ডেকে আনছে শ্বাসযন্ত্রের দুর্বলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, এমনকি ক্যান্সার-এর মতো মারণরোগকেও। দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে চলতি বছরের রিপোর্টে এমনটাই জানিয়েছে সংবাদসংস্থা পিটিআই-ও।
আরও শুনুন: ‘আমাদের বাঁচান’, প্রধানমন্ত্রীর কাছে কাতর আর্তি কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের তরুণীর
আসলে রাজনৈতিক নেতৃত্বদের কথায় বারবার এর উলটো ছবিটাই মিলেছে। নোট বাতিলের সময় দেশের প্রতিটি মানুষের অ্যাকাউন্টে বড় অঙ্কের অর্থ জমা পড়ার প্রতিশ্রুতি মিলেছিল সরকারের তরফে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে দ্রুত উন্নতি করছে দেশ, এমনই স্বপ্ন দেখিয়েছেন ডিজিটাল ইন্ডিয়ার প্রবক্তারা। করোনাকালেও শ্রমিকদের মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা, অনাহারে মৃত্যু, সাধারণ মানুষের চাকরি হারানো- সবকিছু নিয়েই মুখে কুলুপ এঁটেছিল সরকার। উলটে এই পরিস্থিতির দারুণভাবে মোকাবিলা করেছে ভারত- এমন প্রশংসার কথাই শোনা গিয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখে। প্রধানমন্ত্রিত্বের অষ্টম বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং ঘোষণা করেছেন, “বিগত বছরগুলিতে আমরা দরিদ্রদের সেবা এবং কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি।” এসবই কি তাহলে নিছক কথার কথা? যেখানে রোজকার খাবারটুকু জোগাড় করতেই সাধারণ মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে উন্নতির ফাঁপা বুলি দিয়ে কি কেবল রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা চলছে- এমনই নানা প্রশ্ন উঠে আসছে এবার।