মিম কি মানুষের মতামত তৈরি করতে পারে? বিশেষত ভোটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে? ক-দিন আগে পর্যন্তও এ নিয়ে সংশয় ছিল। তবে, ইদানীং রাজনীতির দুনিয়ায় মিমের যা আধিপত্য, তাতে বলাই যায় যে, মিম আর হেলাফেলার বস্তু নয়। ভোটের হাওয়ায় কীভাবে জায়গা করে নিল মিম? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
মিম কতটা নৈতিক আর কতখানি রাজনৈতিক? সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে ভোটের হাওয়ায় যা নিয়ে কোনও সংশয় নেই, তা হল মিমের দাপট। বলতে গেলে, ভোট প্রচারের একটা জরুরি হাতিয়ারই হয়ে উঠেছে মিম। এবং কোনও রাজনৈতিক দল তাই তা নিয়ে হেলাফেলা করছে না।
অথচ বছর কয়েক আগেও মিম-কে জরুরি হিসাবে দেখার রেওয়াজ সেভাবে শুরু হয়নি। ভোটের সময় নেতা-নেত্রীদের বাক্যবাণে হিউমারের ছোঁয়া চিরকালই থাকে। তা নিয়ে লেখালিখি হয়। দেওয়াল লিখনেও থাকত প্রতিপক্ষকে খোঁচা দেওয়া নানা কথা। সব মিলিয়ে ভোটের হাওয়ায় হিউমারের যে জায়গা ছিল, তা বোঝাই যায়। আর হিউমারের ক্ষমতা হল বহু কথা খরচ করে যা না বলা যায়, তা বুঝিয়ে দেওয়া যায় খুব সহজেই। অতি দ্রুত তা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে এর জুড়ি মেলা ভার। গত এক দশকে ভোটের প্রচারের মাধ্যমে অনেক বদল এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকার অভ্যাস যেভাবে মানুষকে পেয়ে বসেছে, তাতে মিম কালচারের সঙ্গে বেশিরভাগ মানুষই আর অপরিচিত নন। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলি তো চায়ই যে, ভোটের হাওয়ায় তাদের দলের অবস্থান দ্রুত বহু মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ুক। অতএব মিমকে গুরুত্ব না দিয়ে আর উপায় নেই। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে মিম এতটাই পরিচিত এবং ভাগ করে নেওয়ার মতো একটা জিনিস যে, রাজনীতি তার নিজের স্বার্থেই এখন মিমের দ্বারস্থ হয়েছে।
আরও শুনুন: ভোট প্রচারে ঘৃণা ভাষণ বন্ধ হোক, হাজার খানেক পোস্টকার্ড জমা কমিশনে
সোশ্যাল মিডিয়ার এই চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রে বিজেপিকে অনেকটা এগিয়ে রাখতেই হয়। ভারচুয়াল মিডিয়ামকে প্রচারের মাধ্যম করে নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা বরাবরই দড়। দলের ইনস্টাগ্রামে প্রায় ৭.৮ মিলিয়ন ফলোয়ার আছেন, যা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির থেকে অনেক বেশি। স্বাভাবিক ভাবেই এই মাধ্যমে প্রচারের কীভাবে শান দেওয়া যায়, তা নিয়েও তারা বেশ ভাবনাচিন্তাই করে থাকে। সেই ভাবনার জায়গাতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মিম। গত মার্চ মাসেই দলের তরফে একাধিক মিম পোস্ট করা হয়েছিল। তার বক্তব্য ছিল, দুটো জিনিস দেখতে এক হলেও আদৌ এক নয়। এই ভাবনাতেই বিরোধীদলের একাধিক নেতানেত্রীর উপর কাজ করে তারা। সে তালিকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে কেজরিওয়াল অনেকেই ছিলেন। যথারীতি সেই মিমগুলি গেরুয়া শিবিরের অনুগামীদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল। তবে মিম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারে বিজেপির যে একাধিপত্য, তা এখন অনেকটাই কমেছে। কেননা কংগ্রেসের মতো দলও এই পিচে চালিয়ে ব্যাট করতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক মিম নিয়ে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁদের মনে পড়বে, ওয়াশিং মেশিনের মিম বানিয়ে কীভাবে বিজেপিকে একহাত নিয়েছিল দলটি। সেই মিমের মূল বক্তব্য ছিল, বিজেপিতে যোগ দিলেই, যে কোনও নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ হয়ে যাবে, ঠিক যেভাবে ওয়াশিং মেশিন নোংরা কাপড়কে সাফসুতরো করে দেয়, সেভাবেই। অতএব ভোটের ময়দানে যে লড়াই চলছে, তার একটা পর্ব চলছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। আর তাতে যে দলগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে, তা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মিম বানানোর নমুনা দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
আরও শুনুন: স্বাধীনতার পর থেকে যাননি কোনও প্রধানমন্ত্রী, মোদি পুজো দিয়ে এলেন সেই মন্দিরেও
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মিম-কে এখন আর একেবারেই অগ্রাহ্য করা যায় না। ছেঁদো রসিকতা বলে তাকে পিছিয়ে রাখার কোনও উপায় নেই। কিছুদিন আগে পর্যন্তও ভাবা হত যে, মিম নেহাতই ছেলেছোকরাদের জিনিস। অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মের ব্যাপার। আর সেই তরুণ প্রজন্মকে কাছে টানতেই মিম একান্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার চরিত্র নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা বলছেন কোনও একটা নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে দলগুলি মিম মানায়। অর্থাৎ যে বিষয়টি ট্রেন্ড করছে, তা নিয়ে যদি মিম বানানো যায়, তবে দলের বক্তব্য নিয়ে সহজে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। ফলে সে সুযোগ হাতছাড়া করছে না কোনও দল-ই। কোনও মিম যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়, তবে তা আখেরে দলের জন্য কার্যকরীই হয়ে ওঠে। তবে মজার বিষয় হল, মিম যে এখন স্রেফ তরুণদের বিষয়, তা কিন্তু নয়। পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সেই মানুষই এই রাজনৈতিক রসিকতা উপভোগ করেন। ফলে শুধু ভোট প্রচারেই নয়, সামগ্রিক ভাবেই দলের কাছে মিমের গুরুত্ব বেড়েছে।
তা ছাড়া ইদানীং ভোট প্রচারের রীতিনীতিও অনেক বদলেছে। পলিটিক্যাল ক্যাম্পেনের জন্য গান তৈরির রেওয়াজও আগে সেভাবে ছিল না। এখন তা জলভাত হয়ে গিয়েছে বলা যায়। সেরকমই মিমও এখন ট্রেন্ডি পলিটিক্যাল টুল। তার জন্য টিম-ও মোতায়েন করে রেখেছে রাজনৈতিক দলগুলি। তবে এই রসিকতার জেরে কি ভোটেই অন্যান্য দিক থেকে নজর সরে যেতে পারে? সে সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে তা সত্ত্বেও ভোটের রাস্তায় মিম-এর দৌড় কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যায় না।