‘সোনিয়া গান্ধির পুতুল’, ‘আকস্মিক প্রধানমন্ত্রী’, ‘রোবট প্রধানমন্ত্রী’-সহ কত না টিটকিরি শুনতে হয়েছে মনমোহন সিং-কে। এমনকী মেরদণ্ডহিন বিদ্রূপ-ও। তবে, সেই সব মশকরার বিসর্জন হয়েছে মানুষটির কাজ আর মৃদুভাষে। রাজনীতি মানেই কি কেবলই চিৎকার? অন্যকে লাগামহীন আক্রমণ? অশালীনতাকে সাহসিকতা হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া? আজ যখন সেসবই রেওয়াজ, তখন মৃদু অথচ ঋজু স্বরের রাজনীতিবিদ হিসাবেই পথ দেখাতে পারেন মনমোহন সিং।
লিখছেন, সৌরাংশু।
ভারতবর্ষে একটা কথা প্রচলিত আছে, বিভিন্ন ভাষায় তার বয়ান খানিক খানিক আলাদা, তবে ভাবখানা এক– ‘যে বাচ্চা বেশি কাঁদে মা তার মুখেই আগে স্তন্য দেয়’। বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে কথাটিকে ফেলে দেখা যায় অনায়াসে। মায়ের জায়গায় যদি ভারতীয় জনতার কথা ধরে নিই তাহলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, ‘বাচ্চা’ হিসাবে কার প্রতি ইঙ্গিত করা হচ্ছে বা করা হতে পারে।
আসলে দর্শনধারীরা গুণবিচারীকে স্বচ্ছন্দে ঢেকে দিয়ে ভারত মায়ের কোল আলো করে বসে থাকেন। কিন্তু ব্যতিক্রম কি ছিলেন না? গত শতাব্দীর নয়ের দশকে ইন্দ্রকুমার গুজরালের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জনপ্রিয়তা কমার প্রধান কারণ ছিল তিনি নাকি জননেতা নন। জনতার ভোট জিতে তিনি প্রধানমন্ত্রী হননি, তাই বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কিন্তু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই সরে যেতে হয় তাঁকে।
নয়ের দশকেই রাজনীতিতে উত্থান হয় আরেক ব্যক্তিত্বের। ভারতের টালমাটাল অর্থনীতিকে বাজার-অর্থনীতির নৌকায় সওয়ার করে যিনি আধুনিক ভারতের উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। যদিও তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। কিন্তু ২০০৪-এ সোনিয়া গান্ধির নেতৃত্বে লোকসভা নির্বাচন জিতে আসার পরে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স কতকটা দায়ে পড়েই যেন তাঁকে ভারতের ত্রয়োদশ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনোনীত করে। নির্বিরোধ অথচ দায়িত্বশীল, ডঃ মনমোহন সিং। মিতভাষী এই ব্যক্তিকে তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় ‘সোনিয়া গান্ধির পুতুল’, ‘আকস্মিক প্রধানমন্ত্রী’, ‘রোবট প্রধানমন্ত্রী’-সহ কত না টিটকিরি শুনতে হয়েছে। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারে একের পর এক দুর্নীতি যখন প্রকাশ্যে আসছে তখন ‘মেরুদণ্ডহীন’ তকমা লাগাতেও ছাড়েনি কেউ কেউ।
অথচ মনমোহন সিং তাঁর সুদীর্ঘ কেরিয়ারে আর যাই হোক মেরুদণ্ডহীনের মতো কোথাও কোনও কাজ করেননি। সাফল্য হোক বা ব্যর্থতা, উভয় ক্ষেত্রেই নিজের সিদ্ধান্ত এবং কর্মের দায় বা দায়িত্ব সবসময়ই মাথায় করে নিয়েছেন। অনুচ্চ স্বরে হলেও নিজস্ব জোরদার বক্তব্য রাখতে কখনই পিছপা হননি।
অন্তত দুটি ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে নিজের, সরকারের বক্তব্য জোরালোভাবে রেখেছিলেন তিনি।
প্রথমবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ জুনিয়রের সঙ্গে ভারতের হয়ে দীর্ঘমেয়াদি পারমাণবিক শক্তি চুক্তি করার পর প্রবল বিরোধিতার মুখে ঋজুভাবে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন– ‘একটি যথাযথ, পক্ষপাতশূন্য এবং ন্যায়পরায়ণ বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করার জন্য যে কোনও প্রয়াসে শামিল হতে ভারত কখনই পিছিয়ে থাকবে না।’ এবং ‘সেক্ষেত্রে ভারতবর্ষ কখনই পারমাণবিক শক্তির মতো এক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আপাত ক্ষতিকারক শক্তিভাণ্ডারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করবে না এবং করতে দেবেও না।’
হয়তো বহুজন তখন বুঝতে পারেননি, কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে এক দায়িত্বশীল ভবিষ্যৎদ্রষ্টার বক্তব্য কতটা অমোঘ হয়ে ওঠে বলুন তো?
অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের দায় এবং দায়িত্ব নিয়ে তাঁর বক্তব্য– ‘যে কোনও সরকারের সত্যিকারের পরীক্ষা তখনই হয়, যখন অসুরক্ষিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনকে মাথায় রেখে সরকারকে নীতি তৈরি করতে হয়। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুফল যেন প্রতিটি দুরূহ কোণেও অধরা না থাকে তা এক দায়িত্ববান সরকারের অবশ্যকর্তব্য!’
জনপ্রিয় হওয়া সহজ, আজকের দুনিয়ায় কাঁদুনে বাচ্চার মুখে চিনি-কাঠি গুঁজে দিয়ে চিৎকার করে কিংবা ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে কান্না হয়তো খানিকক্ষণের জন্য বন্ধ করা যায়। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে জনতার কথা চিন্তা করে কাজ করতে গেলে গলা নয়, কলজের জোর লাগে।
সংযমী এই ব্যক্তির গলার জোরের অভাব ছিল; কাগজে-কলমে তিনি হয়তো তথাকথিত শক্তসমর্থ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর ছেড়ে যাওয়া সিংহাসনের দিকে আজ সাড়ে দশ বছর পরে তাকিয়ে আরও বেশি করে মনে হয় মৃদুভাষী হলে, সংযমী হলে যে দৃঢ়চেতা হওয়া যায় না তা তো একশো শতাংশই ভুল। মনমোহন সিং তাঁর কাজ দিয়ে সারা জীবন মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন। আজকের সময়ে যখন রাজনীতি মানে একে অপরের দিকে ভাষা এবং ব্যবহারে লাগামহীন হয়ে অশালীনতাকেও সাহসিকতা বলে চিহ্নিত করে এক নকল ফোলানো বেলুনকেই আসল মুখ বলে ধরে নেওয়া হয়, তখন আরও বেশি করে তাঁর চলে যাওয়াটা মনে বাজে।
মনমোহন সিং এক আকস্মিক রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন, এবং আরও বেশি করে আকস্মিক প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর মতো মৃদু, শান্ত অথচ দৃঢ়চেতা চরিত্র যেন বর্তমান ভারতবর্ষের আরও বেশি করে প্রয়োজন। চলে যাবার দিনে এই কথাটাই মনে করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন নিপাট ভদ্রলোক ড.মনমোহন সিং।