অবসর নিয়েছেন কয়েক মাস আগেই। ব্যাঙ্কে জমানো রিটায়ারমেন্টের টাকা। ভবিষ্যতে নিজের জন্য কিছু করার নেই, পরিবারের দরকারে খরচ হবে। নিশ্চিন্তে কাটাচ্ছিলেন অবসর জীবন। সঙ্গী বলতে ছিল কয়েক হাজার বই। মাঝেমধ্যে আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া-আসা লেগে থাকত। এমনই এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে শহর ছেড়ে অনেকটা দূরে গিয়েছিলেন। হঠাৎ একটা ফোন এলোমেলো করে দিল সবকিছু।
ধুলোয় মিশেছে সব। সম্মান, সম্পত্তি, ভালোবাসা, সবকিছু। একসময় যা অন্যায় তা প্রমাণ হয়েছে। ক্ষতিপূরণের আশ্বাস পেয়েছেন। তবু শান্তি নেই। সবকিছু কেমন নিস্প্রভ। সুবিচারে এতটুকু আনন্দ পাচ্ছেন না উর্দু পণ্ডিত। আক্ষেপের সুরে একটাই কথা বলে চলেছেন, ‘আর হারানোর কিছু নেই’!
ঘটনা ২০২১ সালের। কেন্দ্রে রয়েছেন যোগীরাজ্যের উর্দু পণ্ডিত আলি আহমেদ ফাতমি। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। সেই সুবাদে পরিচিতি, সম্মান। স্বপ্নেও ভাবেননি সবকিছু এক ধাক্কায় ধুলোয় মিশে যাবে। অবশ্য ধাক্কা যদি বুলডোজারের হয়, তাহলে এমনটাই স্বাভাবিক। বিষয়টা পরিষ্কার করে বললেই বোঝা যাবে।
যোগীরাজ্যে বুলডোজারের ভাষা অচেনা নয়। মুখ্যমন্ত্রী যোগী যদিও এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলার প্রসঙ্গ জুড়েছেন বারবার। তাঁর যুক্তি, কেউ যদি আইনি কাঠামোর মধ্যে বিচার চান, তাহলে আইন আইনের পথেই চলবে। আর কেউ যদি হিংস্র হন, তাহলে সেভাবেই তার উত্তর দিতে হবে। আর এ প্রসঙ্গেই বুলডোজারের আগ্রাসনকে এক রকমের জবাব দেওয়ার ভাষা হিসাবেই তুলে ধরেছেন তিনি। দেশের রাজনীতিতে বুলডোজারের এই চলাফেরা উত্তপ্রদেশের রাজনীতি হিসাবেই পরিচিত। তবে সবক্ষেত্রে যে সঠিক বিচার হয় এমন নয়। এদিকে বুলডোজার নীতির প্রয়োগে ফিরে পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ভুল করে কারও বাড়ি বা সম্পত্তি ধুলোয় মিশিয়ে দিলে তার পুনুরুদ্ধার একেবারে অসম্ভব। এক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক তাই। উর্দু পণ্ডিয় ফাতমি তখন জামশেদপুরে, আত্মীয়ের বাড়ি। হঠাৎ একটা ফোন পেয়ে ছুটে এলেন প্রয়াগরাজ। সেখানেই তো তাঁর স্থাবর অস্থাবর সবকিছু গচ্ছিত আছে। ফিরে এসে দেখলেন, বলা ভালো দেখতে বাধ্য হলেন, সেইসব সম্পত্তির ধুলোয় মিশে যাওয়ার দৃশ্য। ৩০ বছরের পুরনো বাড়ি, সাধের বাগান, পাঁচিল, গাছ, এমনকি যত্ন করে সংগ্রহ করা কয়েক হাজার বই। একজন পণ্ডিত, যিনি বইকে অমূল্য মনে করেন, এ দৃশ্য সহ্য করা মোটেও সহজ কিছু নয়। তাও দাঁতে দাঁত চেপে সবটা মানতে বাধ্য হলেন ফাতমি। অবশ্য করার মতো কিছুই ছিল না তাঁর। যে ফোন পেয়ে ছুটে এসেছিলেন, তার এপারে ছিল তাঁর মেয়ে। বাবাকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে তিনি জানিয়েছিলেন, সরকারি ফতোয়া এসেছে, তাঁদের বাড়ি ভেঙে ফেলা হবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, অবৈধ জমিতে তৈরি সম্পত্তি। সরকারি নোটিশ পাঠানোর একদিনের মধ্যেই বুলডোজার হাজির হয় বাড়ির সামনে। আইনি পথে বিষয়টা হয়তো আটকানো যেত, কিন্তু সেটুকু সময় দেওয়া হয়নি পণ্ডিত ও তাঁর পরিবারকে।
শুধু তাঁর একার বাড়ি নয়, আশেপাশে আরও অনেক বাড়িই ওইভাবে ভেঙে ফেলা হয়। ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়, কতশত রক্ত-ঘাম-ভালোবাসা-আবেগ! সরকারের তরফে অবশ্য এ পদক্ষেপের বিশেষ ব্যাখ্যা ছিল। বলা হয়েছিল, এই কড়াকড়ি উত্তরপ্রদেশের জমি মাফিয়াদের উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য। হিসাব করে দেখানো হয়েছিল, যোগীরাজ্যে প্রায় ২০০০ একর সরকারি জমি অবৈধভাবে জব্দ করা হয়েছে। সেই তালিকায় কোনওভাবে উর্দু পণ্ডিতের বাড়িটাও ঢুকে যায়। হয়তো ভুল করেই, কিন্তু ঠিক-ভুল বিচার করার মতো সময় তখন ছিল না। কাজেই সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখতে বাধ্য হন ফাতিম ও তাঁর পরিবার। কোনওক্রমে এক আত্মীয়ের বাড়িতে মাথা গোঁজেন। জমানো টাকা দিয়ে একটা ফ্ল্যাটও কেনেন, তবে সেখানে ওঠে তাঁর মেয়ের পরিবার। তাঁদের বাড়িও একইভাবে ভেঙে ফেলে হয়েছিল। অপমানে, চিন্তায় ভেঙে পড়েন উর্দু পণ্ডিত। বিচার হবে একথা জানতেন, তাও হঠাৎ নেমে আসা এই ব্জ্রপাত সহ্য করতে সমস্যা হয়েছিল। বিষয়টা আরও জটিল হয়, তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে। ডায়েবেটিসের রোগী, স্বামীর এই অপমান সহ্য করতে পারেননি। বই, বাড়ি, লাইব্রেরী, সম্মান হারিয়ে একা হয়েছিলেন ফাতমির। স্ত্রী-র চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই একাকীত্ব আরও বাড়ে। তবু লড়াই থামেনি। আইনের পথেই এগিয়েছিলেন। বিচারও হয় সেই পথেই। শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয়, উর্দু পণ্ডিতের বাড়ি ভাঙা একেবারেই অনৈতিক। এর জন্য তাঁকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশও দেন বিচারপতি।
এত লড়াই শেষে জয়, সুবিচার, তবু নিরুত্তাপ উর্দু পণ্ডিত। হাসি নেই তাঁর মুখে। কারণ এই লড়াই স্রেফ ক্ষতিপূরণের আদায়ের জন্য নয়। সুবিচার পেলেও ধুলোয় মিশে যাওয়া সম্মান আর হয়তো ফিরে পাবেন না উর্দু পণ্ডিত। ফিরে পাবেন না তাঁর সাধের বইগুলোকে। একটা ভুল, যা অন্যায়ভাবে তাঁর জীবনে এমন শূণ্যস্থান তৈরি করেছে, তা কোনও আইনি নির্দেশ ভরাট করতে পারবে না। এসব ভালমতো জানেন ফাতমি। তাই আক্ষেপ ছাড়া আর কিছু উদযাপনের মতো নেই তাঁর কাছে। জীবনের বাকি দিনগুলো এমনই শূন্যতার আঁধারে তাঁকে কাটিয়ে দিতে হবে। কোনও উপায় নেই, কোনও পথ নেই, কোনও আশা নেই।