বন্ধ হোক মন্দির-মসজিদ বিতর্ক। আগুনে ঘি ঢালা বন্ধ হোক। বরং কথা হোক সত্যিকারের সমস্যাগুলো নিয়ে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের কাছে এই দাবিই জানালেন জ্ঞানবাপী এলাকার স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে এই দাবিতে সরব হচ্ছেন তাঁরা। ঠিক কী বলছেন এই মানুষেরা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
মন্দির-মসজিদ বিতর্কে উত্তাল গোটা দেশ। আর আপাতত সেই বিতর্কের কেন্দ্রে বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ। ধর্মীয় বাকবিতণ্ডা ছাড়িয়ে জোরদার আইনি লড়াইয়ে মুখোমুখি মন্দির ও মসজিদ পক্ষ। দুই পক্ষের চাপানউতোরে ধুঁইয়ে উঠছে সাম্প্রদায়িকতার আগুন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কোন পক্ষের দিকে ঝুঁকছেন স্থানীয় মানুষেরা? সম্প্রতি সামনে এল সে কথাই।
আরও শুনুন: কুতুব মিনার কি আদৌ দিল্লিতে ছিল! বিষ্ণুর সঙ্গেই বা কী যোগ এই স্তম্ভের?
কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের একটি অংশ ভেঙে সেখানে জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরি করিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব, এই দাবি নিয়ে একাধিকবার সরব হয়েছিল কোনও কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠী। ১৯৯১ সালে এমন একটি মামলা আদালত অব্দি গড়ালেও তা ডিসমিস হয়ে যায়। কিন্তু চলতি বছরে ফের আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন পাঁচ মহিলা। মসজিদ চত্বরে ফের পূজার্চনার অধিকার চেয়েছিলেন তাঁরা। এই মামলার জেরে মসজিদের ভিতরে সমীক্ষা ও ভিডিওগ্রাফির নির্দেশ দেয় বারাণসীর দায়রা আদালত। মসজিদের ওজুখানায় শিবলিঙ্গ মিলেছে বলে দাবি করা হয় সমীক্ষার রিপোর্টে। সব মিলিয়ে বড়সড় বিতর্ক শুরু হয়েছে এই মসজিদ ঘিরে। এই ইস্যুতে একের পর এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মন্তব্য, পালটা মন্তব্যের জেরে আরও ঘোরালো হচ্ছে পরিস্থিতি। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানালেন জ্ঞানবাপী এলাকার স্থানীয় মানুষেরা।
আরও শুনুন: হিন্দু রাজার জমিতেই গড়ে উঠেছিল তাজমহল, কীসের বিনিময়ে পেয়েছিলেন শাহজাহান?
জ্ঞানবাপী এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী সাফ জানালেন, বর্তমানের মন্দির-মসজিদ বিতর্ক নিয়ে আদৌ আগ্রহ নেই তাঁদের। বরং এই বিতর্কের জেরে ভবিষ্যৎ কোনদিকে বাঁক নিতে চলেছে, তা নিয়েই তাঁরা বেশি চিন্তিত। অর্ধশতাব্দী পুরনো একটি দোকানের মালিক জাভেদ আখতার বলছেন, জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে ক্রিকেট খেলতেন তাঁরা, আবার পাশের মন্দির থেকে লাড্ডুও খেতেন। এখন নিজেদের ফায়দা লাভের জন্য মন্দির মসজিদ নিয়ে তাঁদের লড়িয়ে দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতারা, এমনটাই দাবি জাভেদের। সে কথায় দ্বিমত নেই ওই এলাকার পানদোকানি এবং ব্যবসায়ী সমিতির প্রধান বল্লভদাস আগরওয়ালেরও। ব্যবসার ভাবগতিক একেবারেই সুবিধের ঠেকছে না তাঁর। সিল্ক আর ধর্মীয় পর্যটন, এখানকার প্রধান ব্যবসা ছিল এই দুটিই। যেখানে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষই কাজ করেন। বিশেষ করে বেনারসির কারিগরদের মধ্যে সিংহভাগই মুসলিম। ওই ব্যবসায়ীর মতে, আগে এই এলাকায় বিপুলসংখ্যক টুরিস্টদের দেখা মিলত। ফলে ব্যবসা চলত রমরমিয়ে। আর সেই কারণেই কোনও দিনই মন্দির-মসজিদ বিতর্ক নিয়ে মাথা ঘামাতে চাননি এই ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এই বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পর থেকেই এই স্থান এড়িয়েই চলছেন অধিকাংশ টুরিস্টরা। ফলে টান পড়েছে রোজগারেও। এই পরিস্থিতিতে শাড়ি নিয়ে অন্য শহরে গিয়ে বিক্রির চেষ্টা করবেন কি না, এহেন দ্বিধায় পড়েছেন পুরনো শাড়ি ব্যবসায়ীরাও। অবস্থা আরও খারাপ জনমজুর এবং সাধারণ শ্রমিকদের। দিন প্রতি ৩০০ টাকায় কাজ করা মজুরেরা এখন অধিকাংশ দিনই কাজ না পেয়ে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
নিত্যদিনের রুটিরুজি জোগাড় করাটাই যেখানে লড়াই, সেখানে এই জাতীয় বিতর্ককে অর্থহীন বলেই মনে করছেন জ্ঞানবাপী এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী। ক্রমবর্ধমান বাজারদর, জ্বালানির আকাশছোঁয়া দাম, বেকারত্বের মতো জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে বরং ভাবতে চাইছেন তাঁরা। রাজনৈতিক নেতারা মন্দির মসজিদ বিতর্কে অযথা ঘি না ঢেলে বরং এইসব সমস্যার সুরাহা করুন, এই দাবিতেই এখন সরব জ্ঞানবাপী এলাকার সাধারণ ব্যবসায়ীরা।