নির্বাচনের মরশুম। দেশজুড়ে চালু হয়েছে আদর্শ আচরণবিধি। বেচাল হলেই দেদার শোকজ। শাস্তির ভয়ে নিজেদের বক্তব্যে লাগাম টানতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু নির্বাচন মিটে গেলে? বাকি সময় কি তবে কু-কথায় দেদার ছাড়পত্র? আসুন শুনতে শুনতে একটু ভেবে দেখা যাক।
এমনি সময় কু-কথায় পঞ্চমুখ হতে যেন দোষ নেই। তবে, ভোট এলেই হাওয়াবদল। মুখ থেকে বেফাঁস খসেছে কি শাস্তির কোপ! রাজনীতির মঞ্চে এ খুব চেনা ছবি। প্রতিবার ভোট এলেই দেখা যায় কোনও কথা ব্যক্তি আক্রমণের খোপে গিয়ে পড়ছে, তো কোনও কথা যে নারীবিদ্বেষী; তা নিয়ে চলছে নালিশের পালা।
এবারের ভোটের কথাই ধরা যাক। লোকসভার দামামা তো বেজেই গিয়েছে। ফলত নেতা-নেত্রীদের মুখের কথার উপর চলছে কড়া নজরদারি। ইতিমধ্যে কয়েকটি মন্তব্য নিয়ে জলঘোলা হতেও শুরু করেছে। যেমন, কঙ্গনা রানাওয়াতকে নিয়ে কংগ্রেস নেত্রী সুপ্রিয়া শ্রীনাথের মন্তব্যে তোলপাড়। কঙ্গনা এই প্রথমবার নির্বাচনে লড়ছেন। যেই না ঘোষণা, অমনি প্রতিপক্ষ দলের নেত্রী একটি কু-কথা বলে ফেললেন, তাও আবার সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই পোস্টে যে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত ছিল তা সকলের কাছেই স্পষ্ট। নেত্রী আত্মপক্ষ সমর্থনে কঙ্গনার পুরনো মন্তব্য টানতে গিয়েছিলেন বটে। তবে, ভোটের মরশুমে সেসব যুক্তি টেকে না। অতএব নির্বাচন কমিশন শোকজ নোটিস পাঠিয়ে দিয়েছে। এদিকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে অবমাননাকর মন্তব্য করে বসেছেন বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ। তা নিয়েও কমিশনে নালিশ জমা পড়েছে এবং প্রত্যুত্তরে একই পদক্ষেপ কমিশনের। তাঁর দলও তাঁকে এমন মন্তব্য করার কারণ ব্যাখ্যা করতে নির্দেশ দিয়েছে। সম্প্রতি আবার প্রাক্তন বিচারপতি ও বর্তমান বিজেপি নেতা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য নিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা। এগুলো গুটিকয় উদাহরণ মাত্র। ভোটের সময় এরকম আকছার ঘটতে দেখা যায়। নির্বাচন যেন সেই আশ্চর্য ছাঁকনি। যা ঠিক করে দেয়, কোন কথা বলা উচিত, আর কোনটা বলা গর্হিত।
কথায় এই রাশ টানা যে অত্যন্ত ভালো লক্ষণ তা সকলেরই জানা। তবে, প্রশ্ন হল, ভোটের বালাই যেভাবে স্বচ্ছতার পক্ষে টেনে আনছে সকলকে, বাকি সময় কি তা প্রযোজ্য নয়? রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকে। তীক্ষ্ণ কথায় প্রতিপক্ষকে ফালাফালা করে দেওয়া নতুন নয়। তবে, সেই ভাষা কখনই অবমাননাকর হতে পারে না। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা রাজনৈতিক ভাবেই মোকাবিলা করতে হয়। তা যদি ব্যক্তি আক্রমণ, কুৎসা কিংবা যৌনকর্মী কটাক্ষে গিয়ে ঠেকে, তবে সে আচরণ কখনই মান্য হতে পারে না। তা ভোট থাকলেও নয়, না থাকলেও নয়। এই সহজ সত্যিটাই যেন রাজনীতির কুশীলবরা সব সময় মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেন না। ফলত রাজনীতির ভাষাও ক্রমশ তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ভোট ছাড়া বাকি সময় যে ভাষায় আক্রমণ শানানো হয়, তা আর যাই হোক, রাজনীতিসুলভ নয়। তবে, যেহেতু নালিশের ভয় নেই, তাই অন্যান্য সময় আদর্শরক্ষার দায়ও যেন থাকে না।
বর্তমানে আবার সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত। সেখানে কথাবার্তা সম্পাদনার কোনও বালাই নেই। ফলত কু-কথা যেমনই হোক তা সরাসরি প্রচারিত হয়ে যায়। ক্রমাগত সেই কথা শুনতে শুনতে এমন একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়, সৌজন্য থেকে যা বহু দূরে। এবং তা শুনতে শুনতে কানে সয়ে গেলে মনে হয় এই কুৎসার ভাষাই যেন বিরোধিতার। অর্থাৎ কু-কথাই স্বাভাবিকতা পেয়ে যায়। গোলমাল আসলে সেখানেই। তা এমন এক প্রবণতার জন্ম দেয় যা রাজনীতি থেকে গড়িয়ে যায় সমাজের দিকেও। নির্বাচন এলে সেই প্রবণতায় রাশ টানা হয়। তবে আচরণবিধির আদর্শ শুধু নির্বাচনের সময়েই প্রযোজ্য কি না, তা ভেবে দেখারও প্রয়োজন আছে বইকি!