বোলসোনারোর গড়ে যে ধাক্কা লাগতে পারে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। তবু তা হয়েছে। ব্রাজিল নতুন করে সাক্ষী থেকেছে বাম জাগরণের। এই উত্থান কি নতুন কোনও হাওয়া বয়ে আনল বিশ্ব-রাজনীতিতে? কী মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা? শুনে নিন।
জেল থেকে ব্রাজিলের মসনদে বামপন্থী নেতা লুলা-দা-সিলভা। জাইর বোলসোনারোর মতো তাবড় নেতাকে পরাজিত করে ব্রাজিলের নয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। নিজের জয়কে ‘গণতন্ত্রের জয়’ হিসাবেই অভিহিত করেছেন তিনি। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত করার বার্তা দিয়েছেন। বার্তা দিয়েছেন দেশবাসীর খিদে মেটানোর আর একতা রক্ষার। অর্থাৎ দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে যে ক্ষতগুলি তৈরি হয়েছিল, তাই-ই উপশমের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নয়া প্রেসিডেন্ট। আর তাঁর এই নির্বাচন, বিশ্ব রাজনীতিতে একাধিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ট্রাম্প, বোলসোনারোর মতো দক্ষিণপন্থী নেতাদের পতন কি বাম আদর্শের জন্য নতুন রাস্তা খুলে দিচ্ছে? অন্যদিকে মেক্সিকো, কলম্বিয়া, চিলি ও সম্প্রতি ব্রাজিলে বামপন্থার জয়ের দরুন, লাতিন আমেরিকা কি নতুন পর্বের ‘গোলাপি তুফান’-এর সাক্ষী থাকতে চলেছে?
আরও শুনুন: কেবল ধর্ষণের প্রমাণ নয়, সেনাবাহিনীতেও চলত ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’, কোন দেশের নিয়ম জানেন?
এর উত্তর বোধহয় লুকিয়ে আছে বোলসোনারোর জমানাতেই। নিজেকে প্রায় অপরাজিতই ভাবতেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রেসিডেন্ট । তাঁর অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতি যে মুখ থুবড়ে পড়বে এমনটা তাঁর দলের দূরতম কল্পনাতেও আসেনি। ফলে কোভিড মোকাবিলায় যতই ব্যর্থতা বাড়ুক না কেন, স্বীকার করেননি কিছুই। নির্বিচারে ধ্বংস করেছেন আমাজন। বৈষম্য বেড়েছে কয়েকগুণ। দেশের সম্পদের অধিকাংশ কুক্ষিগত হয়েছে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির হাতে। সব মিলিয়ে বোলসোনারো প্রশাসনের উপরই বিরক্ত ছিলেন ব্রাজিলের সাধারণ মানুষ। যে প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ কোনও একটি দল বা ব্যক্তিকে সরকারে নির্বাচিত করে, তার কোনটাই পূরণ করতে পারেননি বোলসোনারো। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অতিরিক্ত পুঁজিপ্রীতি সাধারণ মানুষের থেকে প্রশাসনকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তারই ফল ব্রাজিলের বাম জাগরণ।
আরও শুনুন: ভারতের থেকেও সুরক্ষিত দেশ পাকিস্তান! সাম্প্রতিক সমীক্ষার রিপোর্টে বাধল জোর বিতর্ক
অর্থাৎ মানুষের আস্থা যে বামপন্থার দিকে ঝুঁকেছে তা সত্যি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি একে ‘গোলাপি তুফান’ বলাও যায়, চরিত্রগত ভাবে তা কিন্তু অতীতের থেকে আলাদা। কেননা এই যে বামপন্থার দিকে মানুষ ফিরেছেন, তা যত না আদর্শের টানে তাঁর থেকেও বেশি বিকল্পের সন্ধানে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাইকেল শিফটার বলছেন, ‘এই মুহূর্তে লাতিন আমেরিকা জুড়ে যে যে সরকারের পতন হচ্ছে ঘটনাচক্রে সেগুলি দক্ষিনপন্থী বা সেই ভাবধারার অনুসরণকারী। কিন্তু তাঁর মানে এই নয় যে, লাতিন আমেরিকার মানুষরা দারুণভাবে বাম আদর্শে উদবুদ্ধ হয়েছেন। বরং এটাকে বলা যেতে পারে প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা। মানুষ একটা বিকল্পের সন্ধান করছে।’ অর্থাৎ যে সরকার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না, তাকে বদলে দিতে হবে। জনতার মনোভাব এখানে স্পষ্ট। ঘটনাচক্রে সেই বিকল্প সন্ধানকারী দলগুলি বাম ভাবাদর্শের অনুসরণকারী। কিন্তু তাঁর মানেই যে মানুষ বাম চেতনায় জাগরিত হয়েছে, এমনটা মনে করছেন না বিশ্লেষকরা।
আর-এক বিশ্লেষক গিলহার্ম কাসারোস এই বাম উত্থানের ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন, ‘একই সময়ে পরপর এই ঘটনা ঘটছে, কেননা প্রায় সব জায়গাতেই ক্ষমতায় রয়েছেন দক্ষিণপন্থীরা। তাঁর মধ্যে যে যে প্রেসিডেন্ট পরাজিত হচ্ছেন, তাঁরা মানুষের প্রত্যাশা পূরণে চূরান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।’ তবে এই জাগরণকে সেভাবে ‘গোলাপি তুফান’ বলতে রাজি নন তিনি। কেননা মানুষ যে আদর্শগত ভাবে বাম রাজনীতিকে বেছে নিয়েছেন এমনটা মনে করছেন না তিনিও। বরং তাঁরও ভাবনা ওই বিকল্প সন্ধানের দিকে। নয়া বাম সরকারের প্রতি মানুষের এখন অনেক আশা। অর্থনৈতিক সুস্থিতি আসবে, বৈষম্য ঘুচবে। কিন্তু মহামারী পরবর্তী বিশের অর্থনীতির চাকা যেদিকে গড়িয়েছে, তাতে সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ করা সম্ভব হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। যদি না পূরণ হয়, তাহলে কী হবে? কাসারোসের উত্তর, ‘লুলা যদি সফল না হন, ব্রাজিলিয়ান ভোটারদের সন্তুষ্ট না করতে পারেন, তবে তাঁরা তাঁকেও প্রত্যাখ্যান করবেন। আরও দক্ষিণপন্থী কোনও নেতাকে প্রশাসনে বেছে নিতে দ্বিধা করবেন না।’ অর্থাৎ আদর্শগত পরিবর্তন নয়, বাস্তব চাহিদার নিরিখেই বিকল্প হিসাবে জাগরণ বামপন্থার। লাতিন আমেরিকার রাজনীতি এই নয়া ইঙ্গিতই দিচ্ছে বিশ্বকে।