গুলজার জানিয়েছিলেন, গোটা দেশে কী হচ্ছে, তা কেবলমাত্র এক ভাষার দিকে তাকিয়ে বোঝা যাবে না। মুখমণ্ডলের উপমা টেনে এনে তিনি বলেছিলেন, একটি ভাষা দিয়ে চোখ-নাক স্পর্শ করা যেতে পারে, বড়জোর দাড়ি-গোঁফ ছোঁয়া যেতে পারে। কিন্তু গোট মুখ কি আর স্পর্শ করা যায়? বহু ভাষার এই দেশ তো এভাবেই ভেবে এসেছে, ভাবতে শিখেছে। ভাষার বিভিন্নতার স্পর্শে দেশের বৈচিত্রকে বুঝতে শিখেছে। সেই দেশ কি তবে বদলে যাচ্ছে দ্রুত?
‘আও আব জবাঁয়ে বাঁট লে আপনি আপনি হাম
না তুম শুনোগি বাত না হামকো সমঝ্না হ্যায়
দো আনপড়ো কো কিতনি মহব্বত হ্যায় আদব সে’
লিখেছিলেন গুলজার, তাঁর বিখ্যাত ত্রিবেণী ঘরানার কবিতায়। এ পঙক্তির মোটামুটি বাংলা অর্থ করা যেতে পারে এরকম-
এসো এবার আমাদের ভাষা ভাগাভাগি করা যাক
তুমিও শুনবে না, আমার কাছেও থাকবে না খবর
সাহিত্য কী ভালোই না বাসে, যে না চিনেছে অক্ষর
মাত্র তিনটি পঙক্তি। ভাষা নিয়ে যাবতীয় বিভাজনের বিরুদ্ধেই ঋজু অবস্থান তাদের। পঙক্তির স্রষ্টারও। গুলজারের ত্রিবেণী সিরিজের কবিতার ধর্ম এমনটাই। দু-পঙক্তির নেপথ্যে তিনি বইয়ে দেন অন্য অর্থের এক অদেখা স্রোত। পাঠককে তা বুঝে নিতে হয়। ভাষা কারা ভাগাভাগি করে! সে-উত্তর এ-কবিতাতেই লুকিয়ে রেখেছেন গুলজার- দো আনপড়ো কো কিতনি মহব্বত হ্যায় আদব সে। ভাষার বৈচিত্রেই যে দেশের অনুধাবন সম্ভব, এ-কথা তিনি বহুবার বলেছেন। ভাষার ভিতর দিয়ে দেশকে দেখার যে চেষ্টা আমাদের দেশের সাহিত্যে, গুলজার সে-ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন সমসাময়িক করে। ৩৪টি ভাষার কবিতা-সংকলন তাই নেহাত একটি বই নয়, বরং একই সময়ে নানা ভাষার ভিতর দিয়ে দেশের যে-রূপ ফুটে উঠছে, তাই-ই বোঝার চেষ্টা। এ-কাজ তিনি করেছিলেন বেশ কয়েক বছর আগে। সেই প্রয়াস আবার নতুন করে মনে পড়ছে, প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, যখন ভাষার বিবাদ-বিদ্বেষ নিয়ে বার্তা দিতে হচ্ছে দেশের শীর্ষ আদালতকে। সম্প্রতি, সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট ভাষাতেই জানিয়েছে যে, ভাষা ধর্ম নয়, ধর্মের প্রতিনিধিও নয়।
মাহারাষ্ট্রের পুরসভার সাইনবোর্ডে উর্দু ব্যবহার সংক্রান্ত এক মামলায়, শীর্ষ আদালত জানাতে বাধ্য হয়েছে যে, ভাষাকে বিভাজনের হাতিয়ার করে তোলা উচিত নয়। বরং বিভাজন রুখে, সংযোগ-সমন্বয় ও বৈচিত্র অনুধাবনের মাধ্যম হয়ে উঠুক ভাষা। বিশেষত এই মামলার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যে , পুরসভা তো পরিষেবা দিতেই এই সাইনবোর্ড দিচ্ছে। যে অঞ্চলে পরিষেবা দেওযার কথা হচ্ছে, সেখানকার মানুষ যদি উর্দুতে স্বচ্ছন্দ হন, তাহলে আপত্তি কীসের! কারণ ভাষার প্রথম কাজ তো যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন। তবে এ-কথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া ও বিচারপতি কে বিনোদ চন্দ্রনের বেঞ্চ জানিয়েছে, কোনও ভাষা কোনও ধর্মের দখলে যেতে পারে না। বরং তা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের, সেই অঞ্চলের মানুষের। আদালত জানিয়েছে যে, ভাষা তো সংস্কৃতি। একটি সভ্য়তা প্রগতির দিকে কতটা এগিয়েছে তার চিহ্ন রাখা থাকে ভাষার ভিতর। ভারতীয় সংস্কৃতির যে সমন্বয় তাও এই ভাষবৈচিত্রের মধ্যেই রাখা। এই বৈচিত্রকে কেন অস্বীকার করা হচ্ছে, সে-প্রশ্নই যেন সুপ্রিম-বক্তব্য়ের মূল সুর।
ভাষাভিত্তিক বিভাজন যে কতখানি প্রবল হয়েছে, তা সুপ্রিম কোর্টের এই বার্তাতেই স্পষ্ট। সম্প্রতি, ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের হিন্দি নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক দেখা দিয়েছে। তিন-ভাষা-নীতির প্রস্তাব তো ইতিমধ্যেই দক্ষিণ ভারতে যথেষ্ট বিরুদ্ধতার মুখে পড়েছে, স্বাভাবিক ভাবেই। তবে এই বিষয়গুলো বাদ দিলেও একটা সহজ সমীকরণ বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশে চোখে পড়ছে। কোনও কোনও ভাষাকে বিশেষ বিশেষ ধর্মের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা। উর্দু যে বারবার আক্রমণের মুখে পড়ে, তা এই ভাষা-ধর্মের জোর করে সংযোগ ঘটানোর কারণেই। এই প্রবণতা যে বিপজ্জনক সুপ্রিম বার্তার মধ্যে তা স্পষ্টতই প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এবং তা যে আমাদের মতো মিশ্র সংস্কৃতির দেশে একেবারেই কাঙক্ষিত নয়, এই কথাটিই মনে করিয়ে দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
আর এখানেই গুলজারের পঙক্তি যেন আমাদের চোখ খুলে দেয়- দো আনপড়ো কো কিতনি মহব্বত হ্যায় আদব সে! ভাষা কারা ভাগ করে, তারা কি সত্যিই ভাষাকে ভালোবসে! নাকি তাদের অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে! এ প্রশ্ন করাই আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। এবং এ-প্রশ্ন দেশের রাজনীতির নিরিখে এক খুব প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক প্রশ্নও বটে। এক সাক্ষাৎকারে গুলজার জানিয়েছিলেন, গোটা দেশে কী হচ্ছে, তা কেবলমাত্র এক ভাষার দিকে তাকিয়ে বোঝা যাবে না। মুখমণ্ডলের উপমা টেনে এনে তিনি বলেছিলেন, একটি ভাষা দিয়ে চোখ-নাক স্পর্শ করা যেতে পারে, বড়জোর দাড়ি-গোঁফ ছোঁয়া যেতে পারে। কিন্তু গোট মুখ কি আর স্পর্শ করা যায়? বহু ভাষার এই দেশ তো এভাবেই ভেবে এসেছে, ভাবতে শিখেছে। ভাষার বিভিন্নতার স্পর্শে দেশের বৈচিত্রকে বুঝতে শিখেছে। সেই দেশ কি তবে বদলে যাচ্ছে দ্রুত? ভাষার উপর জুলুম আর তা নিয়ে সুপ্রিম-বার্তায় যেন সেই আক্ষেপটিই বেজে উঠছে।