কৌতুকে অ্যালার্জি। বুলডোজারে অনড়। এই দুই পরিস্থিতি চিহ্নিত করে, এ-দেশের গণতান্ত্রিক মন ও মনন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। রাজনীতি দলে দলে ভাগ হয়ে আলাদা আলাদা পথে চলেছে। তবে, সমালোচনা সহ্য করতে না পারা, আর আগ্রাসনের ভাষাকেই স্বীকৃতি দেওয়া যেন বুঝিয়ে দেয়, এ-দেশের বিরুদ্ধমত গ্রহণের পথটি রুদ্ধ হয়েই গিয়েছে।
কৌতুকের নামে ‘নোংরামি’ করেছেন কুণাল কামরা (Kunal Kamra)। অভিযোগ এমনটাই। আর তাই ইন্দোরের শিন্ডে-সমর্থকরা তাঁকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়েছেন। সাধারণ শৌচালয়ের দেওয়ালে তাঁর ছবি আটকে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে, হাজিরা দিতে বলে কুণাল কামরাকে (Kunal Kamra) দ্বিতীয়বার সমন পাঠিয়েছে মুম্বই পুলিশ। ঘটনাক্রম যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে বোঝা যায়, কৌতুকের ভাষা যেন ‘বিপজ্জনক’ হয়েই দেখা দিয়েছে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে। এদিকে শিবসেনার (উদ্ধবপন্থী) মুখপত্র ‘সামনা’য় কুণাল কামরার (Kunal Kamra) সমর্থনে তুলে আনা হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। কিছুদিন আগেই নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন যে, সমালোচনাই গণতন্ত্রের আত্মা। সেই উদ্ধৃতি দাখিল করে উদ্ধবপন্থী শিব সেনা, শিন্ডেপন্থী শিব সেনার ‘অতি প্রতিক্রিয়া’র তীব্র সমালোচনা করেছে। কৌতুকের ভাষা যে মহারাষ্ট্রের রাজনীতির ফাটলকে আরও একবার খোলসা করে দিয়েছে, তা গোটা দেশের কাছেই স্পষ্ট।
আরও শুনুন: কুণাল কামরা, এমন রসিকতা করা আপনার উচিত হয়নি
কুণাল-কৌতুকের এই ঝালাপালার মধ্যেই দেশের রাজনীতিতে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে উত্তপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের একটি সাক্ষাৎকার। কুণাল কামরা (Kunal Kamra) প্রসঙ্গে বাকস্বাধীনতার অপব্যবহারের বিরোধিতা করেছেন যোগী। হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থান প্রসঙ্গেও নিজের মতামত দ্বিধাহীন ভাবেই জানিয়েছেন। বলেছেন, মুসলিমরা একশো জন হিন্দু পরিবারের সঙ্গে থাকতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করবেন না। কিন্তু, উলটোটা সত্যি নয়। তাঁর প্রশ্ন, ১০০ জন মুসলিমের সঙ্গে ৫০ জন হিন্দু একসঙ্গে থাকতে কি নিরাপদ বোধ করবেন? তাঁর প্রশ্নেই অবশ্য লুকিয়ে আছে উত্তর। এবং এ-উত্তরের ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি সাম্প্রতিক বাংলাদেশ পরিস্থিতি। এবং এসেছে বুলডোজার প্রসঙ্গও। এই বুলডোজার নিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে যোগী-সরকার। তবে, এনিয়ে যে তাঁর কোনও আক্ষেপ নেই, তা উত্তরে স্পষ্ট করে দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। সাফ জানিয়েছেন, কখনও যে যে ভাষা বোঝে, সেই ভাষাতেই তাকে বোঝাতে হয়। অর্থাৎ বুলডোজারের ভাষা যে নয়া ভারতের রাজনীতিরও একটি ভাষা তা নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিয়েছেন যোগী।
আরও শুনুন: ভারত-পাক ম্যাচ ফিরিয়েছে বুলডোজার-রাজনীতি, বিদ্বেষের ‘সেন্ড অফ’ আদৌ সম্ভব?
একদিকে কৌতুকের ভাষা। অন্যদিকে বুলডোজারের ভাষা। আসলে দুই প্রতীক। চিহ্নিত করছে একই সমস্যা। কৌতুক, বিশেষত কুণাল কামরার (Kunal Kamra) কৌতুক, আদতে রাজনৈতিক ফ্যালাসির চাঁচাছোলা সমালোচনা। তা গ্রহণ করতে পারার অপারগতা প্রমাণ করে দিচ্ছে যে, এই দেশের রাজনৈতিক মহলের একাংশের সহনশীলতা তলানিতে গিয়েই ঠেকেছে। সমালোচনা গণতন্ত্রেরই অঙ্গ। যে-কৌতুক সমালোচনাতে শান দেয়, তার উপর চড়াও হওয়া গণতন্ত্রের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে। অথচ ভোট হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর জয়-পরাজয় হচ্ছে। তবে দেশের গণতান্ত্রিক স্বাস্থ্যের যে উন্নতি হচ্ছে না, তা এই ভাবাবেগের ঠুনকোপনা যেন চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিচ্ছে। এ-কথা ঠিক যে, কোনও কোনও রাজনৈতিক দল এই মুহূর্তে কুণাল কামরাকে (Kunal Kamra) সমর্থন করছে। তবে, এই কৌতুক-তির সেই দল বা দলের নেতাদের বিদ্ধ করলে, তাঁদের একই অবস্থান হত কি-না সে সন্দেহ থেকেই যায়। অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে নিজের পছন্দের মত বা কথার বিরোধিতা করাই যেন দস্তুর হয়ে উঠেছে আধুনিক ভারতে।
আরও শুনুন: গরিবকে ঘর দেওয়ার তোড়জোড়, অথচ এক বছরেই দেশে উদ্বাস্তু অন্তত ৫ লক্ষ মানুষ
এই প্রবণতারই আর এক নাম যেন বুলডোজারের ভাষা। যোগী যদিও আইনশৃঙ্খলার প্রসঙ্গ টেনেছেন। তাঁর যুক্তি, কেউ যদি আইনি কাঠামোর মধ্যে বিচার চান, তাহলে আইন আইনের পথেই চলবে। আর কেউ যদি হিংস্র হন, তাহলে সেভাবেই তার উত্তর দিতে হবে। আর এ প্রসঙ্গেই বুলডোজারের আগ্রাসনকে এক রকমের জবাব দেওয়ার ভাষা হিসাবেই তুলে ধরেছেন তিনি। দেশের রাজনীতিতে বুলডোজারের এই চলাফেরা উত্তপ্রদেশের রাজনীতি হিসাবেই পরিচিত। যোগী সরকার বারবার এই কাজের জন্য প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তবে, দেখা গিয়েছে, বারবার একই কাজ করে যোগী সরকার বেশ স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, বুলডোজারের অবস্থানে সরকার অনড়। ক্রমে বিজেপিশাসিত অন্যান্য রাজ্যেও বেড়েছে বুলডোজারের চলাফেরা। দেশের রাজনীতিতে এই ভাষা বেশ নতুন বটে। তবে তা গা-সওয়া করিয়ে দেওয়া হয়েছে বারবার ব্যবহারে। সম্প্রতি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এ নিয়ে সরব হয়েছিলেন। বলেছিলেন, বুলডোজার দিয়ে বিচার কখনই কাম্য হতে পারে না। তাঁর বক্তব্য, যদি কেউ অন্যায় করে থাকেন এবং অভিযুক্ত হন, তাহলে তাঁর বিচার হবে আদালতে। তবে, অভিযোগ ওঠা মাত্র বুলডোজার চালানো যেমন বর্বরতা, তেমন অন্যায়ও বটে। আইন প্রণয়ণকারী, রক্ষাকারী ও আইন ভঙ্গকারীর মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য থাকা উচিত বলেই তিনি মনে করেন। মল্লিকার্জুন খাড়গে আরও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, বুলডোজার আসলে দেশের সংখ্যালঘুদেরই টার্গেট করছে। যোগী সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কথা বললেও, কংগ্রেসের অভিযোগ জানিয়ে দিচ্ছে, বুলডোজারের বিচারের অভিমুখ আসলে কোনদিকে।
অতএব কৌতুকে অ্যালার্জি (Kunal Kamra)। বুলডোজারে অনড়। এই দুই পরিস্থিতি চিহ্নিত করে, এ-দেশের গণতান্ত্রিক মন ও মনন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। রাজনীতি দলে দলে ভাগ হয়ে আলাদা আলাদা পথে চলেছে। তবে, সমালোচনা সহ্য করতে না পারা, আর আগ্রাসনের ভাষাকেই স্বীকৃতি দেওয়া যেন বুঝিয়ে দেয়, এ-দেশের বিরুদ্ধমত গ্রহণের পথটি রুদ্ধ হয়েই গিয়েছে। তা কোন উপায়ে আবার খোলা যায়, জানা নেই। তবে, কৌতুকের ভাষা(Kunal Kamra) নাকি বুলডোজারের ভাষা- এ-দেশের জন্য কোনটি আসলে বিপজ্জনক, তা ঠিক করতে হবে গণতান্ত্রিক ভারতের নাগরিককেই।