মুছে যাচ্ছে বন্দুকের চিহ্ন। বদলে ফুল ফুটছে। কোথাও আবার অন্য কোনও ডিজাইন। নিজেকে বাঁচানোর স্বার্থে কিংবা অন্য কোনও কারনে এমনটাই পদক্ষেপ করছেন যুবকরা। সকলেই যে বাধ্য হচ্ছেন এমন নয়, স্বতস্ফূর্ত ভাবেও বন্দুক মুছে ফুল ফোটানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কেউ কেউ। ব্যাপারটা ঠিক কী? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ডান হাতের কবজির কিছুটা উপরে। সাদা ধবধবে চামড়া। তার উপর ছোট একটা উলকি। কিছু একটা লেখা আছে। উর্দুতে, সহজে সবাই পড়তে পারবেন না। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, কী লেখা? অস্ফূটে কিছু একটা বলে, মানে মানে কেটে পড়লেন যুবক। এভাবে এড়িয়ে যাওয়ার অভ্যাস আজকাল রপ্ত করতে হচ্ছে তাকে।
একইরকম ফরসা আরেকজন। বয়স খুব জোর ২৫। কুনুই অবধি গোটানো জামার হাতা। তার নীচে উঁকি দিচ্ছে বন্দুক। আসল নয়, ট্যাটু। বেশ বড়সর মাপের বন্দুক। বোধহয় একে47। কেন এমন উল্কি, তার কারন একসময় মুখস্থ ছিল। এখনও হয়তো আছে, কিন্তু বলার সাহস নেই। তাই মুছে ফেলাই একমাত্র পথ।
এভাবেই কেউ উর্দু লেখা, কেউ বন্দুক, কেউ আবার বিশেষ কোনও নেতার মুখ, হাতে এঁকে রেখেছে। যা একসময় বেশ গুরুত্ব পেত। কিন্তু এখন সে বালাই নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুছতে হবে। সময়ের প্রয়োজন। পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া গেলে ভালো, অন্যথায় উপরে আরও কিছুর কারিকুরি। যেভাবেই হোক ট্যাটুর আসল ছবি পুরোপুরি ঢেকে দিতে হবে।
কিন্তু এমনটা কারা করছে?
কাশ্মীরের যুবকরা। বর্তমান পরিস্থিতি তাদের এই কাজে উৎসাহিত করছে। কিংবা বাধ্য করছে। স্বাধীনতার পর থেকেই কাশ্মীরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ জটিল। প্রকৃতি নিজের সবটুকু দিয়ে এই ভূখণ্ডকে যেমন সাজিয়েছে, তেমনই এখানকার জীবনযাত্রা একেবারেই অন্যরকম। সমতলের মানুষ যতটা সহজে জীবনযাপন করতে পারেন, এখানকার মানুষ তা ভাবতেই পারেন না। পাহাড়ি এলাকায় খাবার যোগাড় করাটাই রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। কাশ্মীরের সঙ্গে আরও কিছু জটিলতা জুড়ে রয়েছে। সিংহভাগ রাজনৈতিক সমস্যা। বর্ডার এলাকা, তাই সেনা প্রহরা বাড়তি চাপ। তারওপর পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত। যুদ্ধ পরিস্থিতি নতুন কিছু নয়। উদ্বেগে দিন কাটে অলিগলিতে থাকা প্রতিটা সাধারণ মানুষের। রোজগারের উপায়ও বেশ সীমিত। পর্যটকদের উপরই নির্ভরশীল। তাও সারাবছর পর্যটক আসে না। বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় যতটা সম্ভব রোজগার করে জমিয়ে রাখতে হয়। কোনওভাবে সেই পথে ছেদ পড়লে, বছরটা কাটানোই কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সেই কঠিন পথটাকেই বেছে নিতে বাধ্য করছে। সন্ত্রাসবাদী হামলার ভয়ে কাশ্মীর যেতে ভয় পাচ্ছেন সাধারন পর্যটকরা। তাতে মাথায় হাত সেখানকার ব্যবসায়ীদের। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসবের সঙ্গে ট্যাটু মোছার কী সম্পর্ক?
আসলে, কাশ্মীর হামলার পর বিষয়টা নিয়ে যেভাবে চর্চা শুরু হয়েছে তাতে নানা দিক উঠে আসছে। তার মধ্যে একটা দিক হল, হামলার নেপথ্যে কাশ্মীরিদের ভূমিকা। কেউ কেউ এমন দাবি করছেন, কাশ্মীরের সাধারন মানুষের বাড়িতেই ঘাঁটি গেড়েছিল জঙ্গিরা। সেই ধারণা আরও স্পষ্ট হয় সেনা অভিযানের পর। সন্দেহ মেটাতে কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায় সার্চ অপারেশন শুরু করে ভারতীয় সেনা। তাতে অনেকে গ্রেপ্তার হয়। অনেকের সঙ্গেই জঙ্গিদের সরাসরি যোগের কথা সামনে আসে। বিষয়টা ছড়িয়ে পড়তেও সময় লাগেনি। এবং সেই ছড়িয়ে পড়া কথায় জল মিশেছে রীতিমতো। মোটের উপর অনেকেরই ধারনা জন্মেছে, জঙ্গি হামলার নেপথ্যে দায়ী কাশ্মীরের সাধারন মানুষ। তাতে আর যাইহোক, কাশ্মীরের মানুষদের জীবনটা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। এমনিতেই রোজগার বন্ধ, প্রাণের ভয়, তারওপর এই সমস্যা। ট্যাটু মোছার হিড়িকও এখান থেকেই।
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক জটিলতা নতুন কিছু নয়। সেখান থেকে মুক্তির আশায় নানা সময় নানা ভাবে বিরোধ হয়েছে। প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন সাধারন মানুষ। নিজেদের দাবি পূরণের আশায় পথে নেমেছেন কেউ কেউ। স্লোগান উঠেছে। কখনও তা ভারত সরকারের নীতির বিরুদ্ধে গিয়েছে। তবে সেসব অতীত। অনেকেই ভুলেছেন। মনে করতেও চান না। শুধু চিহ্ন রয়ে গিয়েছে। ট্যাটু হয়ে হাতে রয়ে গিয়েছে বন্দুকের ছবি। বর্তমান পরিস্থিতে যার অনেক রকমের অর্থ হতেই পারে। যা নিঃসন্দেহে সমস্যার কারন। তাই মুছে ফেলাই একমাত্র পথ। যদিও এরা সকলেই যে বাধ্য হয়ে ট্যাটু মুছে ফেলছে এমন নয়। তবে সেকথা মনে রেখে আপাতত বন্দুক মুছে ফুল ফোটানোয় মন দিয়েছে। তাতে নিজেরা তো বটেই, পরিবার শান্তিতে থাকবে।