দুর্গাপুজো নয়। সারারাত খাবার কিনতে কেউ ভিড় জমায়নি কেউ। তবু খোলা ছিল রেস্তোরাঁ। লাভ নয়, বিচারের আশায়। চিকিৎসকরা যে দাবিতে রাত জাগলেন, তাতে জুড়তে চাইলেন তাঁরাও। লালবাজার চত্বরে কীভাবে রাত জাগলেন চিকিৎসকরা? ঘুরে দেখলেন শুভদীপ রায়। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
রাত জাগার অভ্যাস তাঁদের রয়েছেই। কিন্তু রাস্তায় বসে নয়। অথচ পরিস্থিতি এমনই যে শহরের রাজপথে বসে রাত কাটাতে বাধ্য হলেন চিকিৎসকরা। এই রাত জাগায় তাঁদের পাশে থাকল গোটা শহর। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অবস্থানে জুড়লেন সাধারণ মানুষ। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল স্থানীয় এক রেস্তোরাঁ। চাইলেই আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা রেস্তোরাঁর শৌচাগার ব্যবহার করতে পারেন, এই মর্মে সারারাত খোলা থাকল দোকান।
আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে উত্তাল গোটা দেশ। দিকে দিকে চলছে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ। বিচারের দাবিতে পথে নামছেন সাধারণ মানুষ। মিছিলে পা মেলাচ্ছেন সেলেব্রিটিরাও। এদিকে কর্মবিরতিতে অনড় ডাক্তাররা। বিকল্প পথে চিকিৎসা পরিষেবা চলছে। একইসঙ্গে বিক্ষোভ আন্দোলনও জারি রেখেছেন তাঁরা। সম্প্রতি পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগের দাবিতে লালবাজার অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন আন্দোলনরত চিকিৎসকরা। প্রতীকী শিরদাঁড়া আর গোলাপফুল নিয়ে মিছিল এগোয় কলকাতা পুলিশের সদরদপ্তরের দিকে।
কিন্তু সেই মিছিল মাঝপথেই আটকে দেয় পুলিশ। রাস্তায় বসে পড়েন চিকিৎসকরা। সারারাত কাটিয়ে দেন এভাবেই। কিন্তু গোটা একটা রাত কাটিয়ে দেওয়া মুখের কথা নয়। তাও আবার রাস্তায়। একদিকে পুলিশের উঁচু ব্যারিকেড, অন্যদিকে শয়ে শয়ে চিকিৎসক রাস্তায় বসে।
এক নয়, একাধিক সমস্যা হতে পারে। খাবার, জল কিছুই ছিল না পর্যাপ্ত পরিমানে। এমনকি রাতের অন্ধকারে শৌচাগার পাবেন কোথায় চিকিৎসকরা? এই চিন্তাও ছিল অনেকের। সবার আগে নেটদুনিয়ায় এই নিয়ে চর্চা শুরু হয়। কেউ বলেন বায়োটয়লেটের ব্যবস্থা হোক, কেউ বলেন প্রোডাকশনের অত্যাধুনিক ভ্যান সেখানে পৌঁছে দেওয়া হোক। এই আবহে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় স্থানীয় বেগ রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ।
এমনিতে রাত ১২ টার পরই বন্ধ হয়ে যায় এই দোকান। এত রাতে এই চত্বরে গ্রাহক হয় না, তাই রেস্তোরাঁ খোলা রেখেও লাভ নেই। কিন্তু সবসময় লাভের বিচার করলে চলে না। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের জন্য সারারাত রেস্তরাঁর শৌচাগার খুলে দেওয়া হয়। বিশেষ করে মহিলারা যাতে কোনও অসুবিধায় না পড়েন সেই কারণেই এমন ব্যবস্থা করে বেগ রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ। রেস্তরাঁর মালিক ইয়াসির বেগ-এর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, চিকিৎসকদের আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে তাঁর। তাই লাভের কথা ভুলে চিকিৎসকদের জন্য এই ব্যবস্থা করেন তিনি। ভোররাত অবধি খোলা ছিল রেস্তরাঁ। ইতিমধ্যেই বায়োটয়লেট পৌঁছে যায় ঘটনাস্থলে। তাতে স্বস্তি পান সকলেই।
যদিও স্রেফ শৌচাগার নয়, আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের যাতে কোনওরূপ অসুবিধা না হয় সেই ব্যবস্থা করতে এগিয়ে আসেন অনেকেই। খাবার, জল সবকিছু পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। কাউকে উঠতে হয়নি। প্রত্যেকের কাছে সময়মতো পৌঁছে দেওয়া হয় জল কিংবা খাবার। আন্দোলনরত এক চিকিৎসক জানালেন, সারারাত তাঁদের সঙ্গে বহু সাধারণ মানুষ ছিলেন। নিকটবর্তী কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে আলাদা ভাবে খাবার তৈরি করে পাঠানো হয়েছিল। এছাড়া কেক, বিস্কুটের জোগান ছিল সবসময়।
:আরও শুনুন:
অন্ধকার সময়ের গান! আন্দোলন যদি নতুন সুরের জন্ম না দেয়, তবে ‘আর কবে’?
তাঁদের হাতে সুস্থ হয়েছেন এমন রোগীরাও এদিনের আন্দোলনে শামিল হন। যার যেটুকু সামর্থ্য সেইমতো চিকিৎসকদের জন্য জল বা খাবার নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁরা। শুধু তাই নয়, গরমের মধ্যে বসে থাকা ডাক্তারবাবুদের জন্য হাতপাখা নিয়ে আসেন অনেকেই। কেউ আবার এগিয়ে দেন টুপি। রাত শেষে ভোর হয়। ধীরে ধীরে বেল বাড়ে। বিনামূল্যে চা নিয়ে হাজির হন স্থানীয় দোকানিরা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আন্দোলনরত চিকিৎসকদের মাথায় ছাউনির ব্যবস্থা হয়ে যায়। বড় করে ত্রিপল টাঙিয়ে দেওয়া হয় গোটা রাস্তা জুড়ে। ততক্ষণে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন আরও শ-খানেক মানুষ। দুপুরে খবার ব্যবস্থাও ছিল। আর জি কর হাসপাতালের পড়ুয়ারা নিজেরা চাঁদা তুলে ক্যান্টিনে খাবার তৈরি করেন। সেই খাবার নিয়ে লালবাজার চত্বরে হাজির হন তাঁরা। রাস্তায় বসেই দুপুরের খাবার খান চিকিৎসকরা। সবমিলিয়ে গোটা এলাকা যেন উৎসবের চেহারা নেয়।
:আরও শুনুন:
শুধু কৌরবদের হাতে নয়, স্বামী পঞ্চপাণ্ডবের হাতেও লাঞ্ছিতা হয়েছিলেন দ্রৌপদী
তবে এই উৎসবে আনন্দ নেই। রয়েছে শোক, রয়েছে দ্রোহ। সারারাত জেগেছেন, তবু ক্লান্তি নেই কারও চেহারায়। ঘুম নেই কারও চোখে। বিচারের দাবিতে যতদূর যেতে হয় তাঁরা যাবেন। যা করতে হয় তাঁরা করবেন। আর এই লড়াইয়ে সাধারণ মানুষ যে চিকিৎসকদের পাশে রয়েছে, তা বুঝিয়ে দিল এদিনে রাতজাগা আন্দোলন।