মহাকাশের প্রতি ছিল তাঁর অমোঘ আকর্ষণ। সেই স্কুলবেলা থেকেই এই অসীম রহস্য টেনে রাখত তাঁকে। শিবপুর কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ই ঠিক করেছিলেন, ইসরোর সঙ্গে যুক্ত হবেন। বাড়িতে কিছু না জানিয়ে দিয়েছিলেন পরীক্ষাও। সেই পথ ধরে এগিয়েই ইসরোর বিজ্ঞানী হলেন উত্তরপাড়ার ছেলে জয়ন্ত লাহা। চন্দ্রযান-৩ যখন স্পর্শ করল চাঁদের দক্ষিণ মেরু, তখন দেশের গর্বে মিশে রইল তাঁর নামও। কেননা এর পরবর্তী ধাপের যে পর্যবেক্ষণ, সেই নেভিগেশনের সঙ্গে যুক্ত তিনি। পাড়ার ছেলের কৃতিত্বে তাই আনন্দে আপ্লুত গোটা উত্তরপাড়া। সাক্ষী থাকলেন শুভদীপ রায়।
চাঁদের দক্ষিণ মেরু ছুঁয়েছে ভারত। ইসরোর সাফল্যে উচ্ছ্বসিত গোটা দেশ। গর্বে ভাসছে বাংলাও। যাদবপুর থেকে শুরু করে বাংলার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম জড়িয়েছে চন্দ্রাভিযানের সঙ্গে। ব্যতিক্রম নয় শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও। সেখানকার প্রাক্তনী তথা উত্তরপাড়ার ছেলে জয়ন্ত লাহা যুক্ত রয়েছেন চন্দ্রযানের নেভিগেশন টিমের সঙ্গে।
আরও শুনুন: চাঁদ ছোঁয়ার স্পর্ধায় শরিক, একটা ‘কালো’ ঘটনা কি মুছতে পারে যাদবপুরের ‘আলো’?
ছোট থেকেই মহাকাশের প্রতি তাঁর আলাদা টান। স্কুলের প্রদর্শনীতে সেই ছাপ স্পষ্ট হত বারবার। স্রেফ মহাকাশ নিয়ে গল্পের বই পড়া নয়, কোথাও কিছু জানার সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন। শিক্ষকদের কাছে মহাকাশের খুঁটিনাটি জানতে চাইতেন। তাঁরাও সবরকমের কৌতূহল মেটাতেন। স্কুলের পর শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সেখান থেকে বিটেক শেষ করে আইআইটি। এরই মাঝে ঠিক করে নিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চায় যুক্ত হবেন। কিন্তু প্রথমেই নিজের এই ইচ্ছার কথা বাড়িতে জানাননি। ইসরোর পরীক্ষাও দিয়েছিলেন কাউকে কিছু না জানিয়েই। প্রথমবারেই এসেছিল সাফল্য। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০৯ সালে ইসরোতে যোগ দেন উত্তরপাড়ার ছেলে জয়ন্ত লাহা। দীর্ঘ ১৪ বছর পর তাঁর সাফল্যে গর্বিত গোটা বাংলার মানুষ। আপ্লুত উত্তপাড়ার বাসিন্দারাও।
আরও শুনুন: চন্দ্র-অভিযানে দিয়েছিলেন মূল্যবান পরামর্শ, ঐতিহাসিক মুহূর্তে ফিরল আব্দুল কালামের স্মৃতি
ছেলের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে আবেগে ভাসলেন বাবা প্রশান্ত লাহা। জানালেন, ছোট থেকেই জয়ন্তর মহাকাশের প্রতি টান। উত্তরপাড়া রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র জয়ন্ত, প্রতিবছর স্কুল একজিবিশনে মহাকাশ সংক্রান্ত বিষয়ে মডেল বানাতেন। সেখান থেকেই শুরু। তারপর শিবপুরের কলেজ হয়ে ইসরো। যদিও ছেলের কাজের ব্যস্ততা এতটাই যে, এখন আর নিয়মিত কথা বলারও সুযোগ পান না। তবু এতটুকু আক্ষেপ নেই। জয়ন্ত আরও সফল হন, সেই প্রার্থনাই করছেন মনেপ্রাণে। একই সুর মা চন্দনা দেবীর গলাতেও। তিনি যোগ করলেন, ছেলের ছবি আঁকার কথা। অবসরে ছবি আঁকতে ভালবাসতেন জয়ন্ত। পেয়েছেন একাধিক পুরষ্কারও। তবে বর্তমানে সময় কাটে চরম ব্যস্ততায়। মাঝারতে বাড়ি ফিরে পরদিন ভোরে আবার অফিস ছুটতে হয়। আর সেই রুটিন শোনালেন জয়ন্তবাবুর স্ত্রী পায়েল লাহা। স্বামীকে বাড়ির দিকে যেন এতটুকু দেখতে না হয় এতদিন সেই চেষ্টাই করে এসেছেন তিনি। বর্তমানে সপরিবারে বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা জয়ন্তবাবু। তবে দিনের বেশিরভাগ সময়টাই তাঁকে কাটাতে হয় ইসরোর দপ্তরে। স্বামীর সাফল্যে গর্বিত স্ত্রী পায়েলও। বললেন, এই খুশি ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
আরও শুনুন: প্রার্থনায় এক মন্দির থেকে মাদ্রাসা, ‘চন্দ্রযান-৩’ যেন ফেরাল সম্প্রীতির সেই আবহমান ভারতবর্ষ
তবে একদিনে সাফল্য আসেনি। দীর্ঘদিনের শ্রম আর অধ্যাবসায়ের ফল এই ‘চন্দ্রযান-৩’-এর অভিযান। জয়ন্তবাবুর সম্পর্কে বলতে গিয়ে বারবার টিম ওয়ার্কের কথা বলছিলেন তাঁর স্ত্রী। ইসরোর এই সাফল্যের কৃতিত্ব সেখানকার প্রত্যেকেরই। তাঁর স্বামী সেই টিমেরই অংশ। তবে জয়ন্তবাবুর আসল কাজ শুরু হবে এইবার। তিনি মূলত নেভিগেশন টিমের সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ চাঁদের মাটি নিরীক্ষণ করা এবং এবং সেখানকার ছবি তোলার গুরুদায়িত্ব তাঁর টিমের উপর রয়েছে। তাই আগামী দিনে কাজের চাপ আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন পায়েল। এর আগে ‘চন্দ্রযান-২’-এর অবতরণ প্রকল্পের সময়ও প্রায়শই বাড়ি ফেরার সময় পেতেন না জয়ন্ত। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং ভবিষ্যতে এই ব্যস্ততা আরও বাড়তে পারে। তবু এতটুকু আক্ষেপ নেই তাঁরও। জয়ন্ত আরও উন্নতি করুন, তিনিও সেই একই প্রার্থনায় রত। একইসঙ্গে চন্দ্রযানের সঙ্গে যুক্ত সকলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। এদিকে উত্তরপাড়ার লাহা বাড়িতে মানুষের ঢল নেমেছে গতকাল থেকেই। তাঁদের অভিনন্দন আর শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দিচ্ছেন শহরতলির বাসিন্দারা।