দ্বিতীয় দফায় কৃষক আন্দোলন শুরু হতেই আন্দোলনকারীদের কণ্ঠরোধে তৎপর কেন্দ্র। সরকারের নির্দেশ মেনে ইতিমধ্যেই একাধিক অ্যাকাউন্ট ব্লক করেছে সোশাল মিডিয়া সংস্থা। কিন্তু সোশাল মিডিয়ায় মতপ্রকাশের সুযোগ কেড়ে নিলেই কি আটকানো যাবে কৃষকদের যন্ত্রণার খতিয়ান?
বিতর্কিত কৃষি বিল প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকদের উত্তাল বিক্ষোভ দেখেছিল দেশ। ফের নতুন করে ফিরেছে কৃষক আন্দোলনের সেই চেনা ছবি। কিন্তু সেই আন্দোলনের গোড়া থেকেই তাঁদের রুখে দিতে তৎপর কেন্দ্র সরকার। দিল্লি সীমান্তে কড়া পাহারা বসানো, অস্থায়ী জেল তৈরি করা থেকে টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়ে মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করা তো ছিলই। পাশাপাশি নিজেদের দাবিদাওয়া বা আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির খবর যাতে কৃষকরা বেশি করে ছড়িয়ে দিতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে সোশাল মিডিয়া ব্যবহারেও কাঁটাতার তুলেছে সরকার। এমনিতে আন্দোলনের শুরুতেই হরিয়ানার সরকার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখার কথা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। উপরন্তু, সম্প্রতি সোশাল মিডিয়া সংস্থা এক্সের তরফে জানা যায়, কৃষক নেতা, কৃষকদের সমর্থনকারী একাধিক ব্যক্তি বা সংগঠনের অ্যাকাউন্ট এবং পোস্ট ব্লক করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র। সোজা কথায়, আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ১৭৭টি এক্স হ্যান্ডেল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক আরও বিবিধ সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকেও এ জাতীয় নির্দেশ দিয়েছিল। দেশের আইন মোতাবেক সে নির্দেশ কার্যকর করতেও বাধ্য হয়েছে সংস্থাগুলি। কিন্তু এতকিছুর পরেও পিছু হটতে নারাজ দেশের অন্নদাতারা। তাঁরা সাফ বলছেন, সোশাল মিডিয়া বন্ধ করলেও তাঁদের বিক্ষোভকে থামিয়ে দেওয়া যাবে না।
আরও শুনুন:
৮৫ শতাংশ মহিলারই ‘কৃষক’ তকমা জোটে না, তবু আন্দোলনে শামিল তাঁরাও
প্রশ্ন উঠবেই, কৃষিপ্রধান এই দেশে কেন বারবার কৃষকদের দাবি আদায়ের জন্য পথে নামতে হচ্ছে? একদিকে সবুজ বিপ্লবের জনককে ভারতরত্নে ভূষিত করা হচ্ছে, এদিকে সেই সময়েই ফের অপ্রাপ্তির খতিয়ান তুলে ধরে পথে নামতে হচ্ছে দেশের কৃষকদের, এই দুই ছবিকে একসঙ্গে মেলানো যায় কেমন করে? যদিও গতবারের আন্দোলনের থেকে এবারের আন্দোলনের দাবিগুলি আলাদা, তবে একটা কথা তো মানতেই হয় যে কৃষকরা তাঁদের প্রাপ্য পাচ্ছেন না। এই মুহূর্তে কৃষকদের মূল দাবি তিনটি- ঋণ মকুব, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপির জন্য আইন আনা, স্বামীনাথন কমিশনের প্রস্তাব লাগু করা। তিনটি দাবিই সঙ্গত। ফসল তো শ্রম আর ঘামের ফসল। তাহলে তার জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তাঁরা পাবেন নাই-ই বা কেন! শুধু তো তাই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত হলে কৃষকদের মাথায় হাত পড়ে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের তাই স্থির কাঠামো জরুরি। উপরন্তু ফসল নষ্ট হয়ে গেলে ঋণ নিয়েও পথে বসে কৃষক। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যতই বলুন না কেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রায় দ্বিগুণ করার পথে হেঁটেছে কেন্দ্রীয় সরকার, দেখা যাচ্ছে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাওয়া কৃষকের সংখ্যা বিবেচনা করলে তাঁরা দেশের মোট কৃষকের সংখ্যার এক ক্ষুদ্র অনুপাত মাত্র। আবার কৃষি মন্ত্রকের জন্য ২০২৩-২৪ সালের বাজেট অনুযায়ী খাদ্যে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ১.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ সালের সংশোধিত অনুমানের তুলনায় ৩১.২% কম। আবার সারের ভর্তুকি ধরা হয়েছে ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের তুলনায় ২২.২% কম। একইভাবে কেন্দ্রের বেশ কয়েকটি বহুবিজ্ঞাপিত কৃষি প্রকল্পেও বাজেট অনুমান গত বছরের সংশোধিত অনুমানের তুলনায় কম। এই সত্যিগুলিকে তো সত্যিই এড়িয়ে যাওয়ার জো নেই। সোশাল মিডিয়াতে যদি এ নিয়ে কথা বলার সুযোগ বন্ধ করেও দেওয়া হয়, তারপরেও অন্নদাতাদের এই সংকট জেগে থাকবেই।
আরও শুনুন:
বাড়ছে মুসলিম বিদ্বেষ, অভিযোগের হার বেশি বিজেপিশাসিত রাজ্যেই, বলছে সমীক্ষা
এই সংকট যে কৃষকদের বারে বারে আন্দোলনের পথে ঠেলে দিয়েছে, এ দেশের ইতিহাসই তার সাক্ষী। ইতিহাস এও জানে, কেবল মুখ বন্ধ করে দিলেই অপ্রাপ্তিকে মুছে ফেলা যায় না। তাই ভাগচাষিদের নিয়ে উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ দখলের দাবিতে তেভাগা আন্দোলন হয়। রাজীব গান্ধী সরকারের আমলেও রাজধানীর বুকে বিপুল জমায়েত করেন কৃষকরা। কৃষি বিলের সময়কার দীর্ঘ আন্দোলনের কথা তো এখনও টাটকা। এবারও টিয়ার গ্যাস হামলা, একাধিক কৃষকের মৃত্যুর পরেও মাটি কামড়ে পড়ে আছেন আন্দোলনকারীরা। ২১ বছরের কৃষক শুভকরণ সিং-এর মৃত্যুর পর রাহুল গান্ধী লিখেছেন, ‘কৃষক এমএসপি চেয়েছিল, তাকে গুলি করা হল, এই কি গণতন্ত্র?’ সত্যি বলতে, অন্য স্বরের কণ্ঠরোধ করতে চাওয়াও যে গণতন্ত্র নয়, সরকারি ফরমানের মুখে সে কথা মনে করিয়েছে এলন মাস্কের সংস্থাও। তবুও, এই সব বিরোধিতার মুখেই প্রতিবাদ জারি রাখছেন কৃষকরা। সোচ্চারে তুলে ধরছেন নিজেদের না-পাওয়ার কথা, সরকারের দাবি না-মেটানোর কথা। ‘সোশাল মুখ’ নাহয় বন্ধ হল, কিন্তু তাঁদের মুখ থেকে অপ্রাপ্তির যন্ত্রণার ছবি মুছবে কে!